চণ্ডীমঙ্গল মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্য ধারার অন্যতম প্রধান কাব্য। এই ধারার অন্য দুই উল্লেখনীয় কাব্য মনসামঙ্গল ও ধর্মমঙ্গল। জনশ্রুতি অনুসারে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের আদি-কবি মানিক দত্ত। এই কাব্যের জনপ্রিয় কবি মুক্তারাম সেন, হরিরাম, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, দ্বিজ মাধব বিশেষ উল্লেখনীয়।
চণ্ডীমঙ্গল দেবী চণ্ডীর মহিমা গীত। কিন্ত প্রাচীন চণ্ডীমঙ্গলের কবিদের বর্ণনায় অভয়া নামে উল্লিখিত এই দেবী আদিতে পুরাণে বর্ণিত দেবী মহিষাসুরমর্দিনী চণ্ডী ছিলেন না। অবশ্য চণ্ডীমঙ্গল রচনার কয়েক শতাব্দী পূর্বেই তিনি পৌরাণিক চণ্ডীর সঙ্গে মিলে গিয়েছেন। অভয়া মুখ্যত বনদেবী যা ঋগ্বেদের দশম মন্ডলের অরণ্যানী স্তবের সাথে সম্পৃক্ত। চন্ডীমঙ্গলের কালকেতু-আখ্যানে তিনি দ্বিভুজা, তার প্রতীক মঙ্গলঘট, পূজার উপচার মাঙ্গল্য ধানদূর্বা।তিনি পশুমাতারূপে পূজিতা।
চণ্ডীমঙ্গলের আখ্যানভাগ মূলত পারস্পরিক যোগসূত্রহীন দুটি পৃথক কাহিনীর সমন্বয়। প্রথম কাহিনী, আখেটিকখণ্ড প্রাচীনতর। দ্বিতীয় কাহিনী, বণিকখণ্ড তুলনামূলকভাবে নবীন। এই দুটি কাহিনীই আনুমানিক ১১০০ সালে, লোককথা বা দেবীমাহাত্ম্যকথা যে কোন রূপেই হোক, অজানা ছিল না বলে জানা গেছে। বৃহদ্ধর্মপু্রাণের একটি শ্লোকেও এই দুটি কাহিনীরই ইঙ্গিত রয়েছে।
আখেটিকখণ্ড বা আক্ষটিখণ্ড ব্যাধ কালকেতু ও তার পত্নী ফুল্লরার প্রতি দেবীর অনুগ্রহের কাহিনী। দেবীর অনুরোধে তার স্বামী শিব তার ভক্ত নীলাম্বরকে অভিশাপ দিয়ে মর্ত্যলোকে পাঠান। নীলাম্বর কালকেতু হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। কালকেতুর যৌবনপ্রাপ্তির পর তার পিতা ধর্মকেতু ফুল্লরার সঙ্গে তার বিবাহ দেন। কালকেতুর পরিবার অতি দরিদ্র কিন্ত সুখী সংসার। এদিকে কালকেতুর শিকারে প্রায় নির্মূলিত কলিঙ্গের বনের পশুদের আবেদনে কাতর হয়ে দেবী স্বর্ণগোধিকা রূপে কালকেতুর শিকারে যাবার পথে প্রকট হলেন। কালকেতুর শিকারে যাবার সময় অমঙ্গলজনক গোধিকা দেখার পর কোন শিকার না পেয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে গোধিকাটিকে ধনুকের ছিলায় বেঁধে ঘরে নিয়ে আসেন। কালকেতু গোধিকাকে ঘরে বেঁধে পত্নীর উদ্দেশ্যে হাটে রওনা হন। হাটে ফুল্লরার সঙ্গে দেখা হলে তাকে গোধিকার ছাল ছাড়িয়ে শিক পোড়া করতে নির্দেশ দেন।
আছয়ে তোমার সই বিমলার মাতা
লইয়া সাজারু ভেট যাহ তুমি তথা।
খুদ কিছু ধার লহ সখীর ভবনে
কাঁচড়া খুদের জাউ রান্ধিও যতনে।
রান্ধিও নালিতা শাক হাঁড়ি দুই তিন
লবণের তরে চারি কড়া কর ঋণ।
সখীর উপরে দেহ তন্ডুলের ভার
তোমার বদলে আমি করিব পসার।
গোধিকা রাখ্যাছি বান্ধি দিয়া জাল-দড়া
ছাল উতারিয়া প্রিয়ে কর শিক-পোড়া।
ফুল্লরা ঘরে ফিরলে, দেবী এক সুন্দরী যুবতীর রূপে ফুল্লরাকে দেখা দিলেন। ফুল্লরার প্রশ্নের উত্তরে দেবী জানালেন ফুল্লরার স্বামীই তাকে এখানে এনেছেন এবং তিনি এই গৃহেই কিছুদিন বসবাস করতে চান।
ইলাবৃত দেশে ঘর জাতিতে ব্রাহ্মণী
শিশুকাল হৈতে আমি ভ্রমি একাকিনী।
বন্দ্যবংশে জন্ম স্বামী বাপেরা ঘোষাল
সতা সাথে গৃহে বাস বিষম জঞ্জাল।
তুমি গো ফুল্লরা যদি দেহ অনুমতি
এই স্থানে কথ দিন করিব বসতি।
হেন বাক্য হৈল যদি অভয়ার তুন্ডে
পর্বত ভাঙিয়া পড়ে ফুল্লরার মুন্ডে
হৃদে বিষ মুখে মধু জিজ্ঞাসে ফুল্লরা
ক্ষুধা তৃষ্ণা দূরে গেল রন্ধনের ত্বরা।
দেবীকে তাড়াতে ফুল্লরা নিজের বারমাসের দুঃখকাহিনী বিবৃত করলেন, তবু দেবী অটল। শেষ পর্যন্ত ফুল্লরা ছুটলেন হাটে, স্বামীর সন্ধানে। উভয়ে গৃহে ফেরার পর দেবীর অনুগ্রহে কালকেতু ধনী হয়ে পশু শিকার ত্যাগ করলেন। বনের পশুরাও নিশ্চিন্ত হল। দেবীর আশীর্বাদে ধনলাভ করে কালকেতু বন কেটে গুজরাত নগর পত্তন করলেন। গুজরাত নগরে নবাগতদের মধ্যে ছিল এক প্রতারক, ভাঁড়ু দত্ত। প্রথমে কালকেতু তাকে বিশ্বাস করলেও, প্রজাদের প্রতি অত্যাচার করায় তাকে তাড়িয়ে দেন। ভাঁড়ু দত্ত কলিঙ্গের রাজার কাছে গিয়ে তাকে কালকেতুর বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে। কলিঙ্গের সেনাপতি গুজরাত আক্রমণ করে কালকেতুকে বন্দী করেন। কিন্তু দেবীর কৃপায় কালকেতু শীঘ্রই মুক্ত হন। কাল পূর্ণ হলে কালকেতু ও ফুল্লরা স্বর্গে ফিরে যান।
বণিকখণ্ডের সূচনায় শিবভক্ত বণিক ধনপতি দেবী পূজায় অস্বীকার করেন। ইন্দ্রের সভার নর্তকী রত্নমালা শাপগ্রস্ত হয়ে ধনপতির প্রথম পত্নী লহনার খুড়তুত বোন খুল্লনারূপে জন্ম নেন। ধনপতি খুল্লনার সঙ্গে তার দ্বিতীয় বিবাহের অচিরেই বিদেশযাত্রায় রওনা হলে, প্রথম পত্নী লহনা তার দাসী দুর্বলার কুপরামর্শে খুল্লনাকে প্রতিদিন ছাগল চড়াতে যেতে বাধ্য করেন। খুল্লনার অষ্টমঙ্গলার পূজায় দেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাকে সমস্ত বিপত্তি থেকে রক্ষা করেন। ধনপতি পুনরায় সিংহলের উদ্দেশে বাণিজ্যযাত্রায় রওনা হন। দেবী ধনপতিকে লাঞ্ছনার মনসায় সিংহলের অনতিদূরে কালিদহে তাকে হস্তীনিধনরত কমলেকামিনী রূপদর্শন করান। কিন্তু দেবীর মায়ায় অন্য কোন নাবিক এই দৃশ্য দেখতে পায় না। সিংহলের রাজার কাছে ধনপতি কমলেকামিনীর বর্ণনা করলে, রাজা বিশ্বাস করেন না। ধনপতি রাজাকে কমলেকামিনী দর্শন করাতে ব্যর্থ হয়ে কারারুদ্ধ হন। পিতার সন্ধানে পুত্র শ্রীপতি(শ্রীমন্ত) সিংহলের উদ্দেশে যাত্রা করেন। দেবীর মায়ায় তিনিও কমলেকামিনী রূপদর্শন করেন এবং সিংহলের রাজার কাছে বর্ণনা করে একই রকম বিপদে পড়েন। রাজা তাকে প্রাণদন্ড দেন। কিন্তু মশানে দেবীর সৈন্যের কাছে পরাস্ত হয়ে রাজা শ্রীপতিকে মুক্তি দিয়ে কন্যা সুশীলার সঙ্গে তার বিবাহ দেন। পুত্র শ্রীপতির প্রয়াসে সিংহলের কারাগার থেকে উদ্ধার পেয়ে ধনপতিও দেবীর মহিমা স্বীকার করতে বাধ্য হন।
কবির আত্মজীবনী থেকে জানতে পারি মোটামুটি খ্রিঃ-এর মধ্যে তার কাব্য রচিত হয়। মুকুন্দের চণ্ডীমঙ্গলের অধিকাংশ ভনিতায় অভয়ামঙ্গল নামে কাব্যটির উল্লেখ পাওয়া যায়। গ্রন্থের ছত্রসংখ্যা প্রায় বিশ হাজার। মুকুন্দের গ্রন্থের এই গ্রন্থের তিনটি খণ্ডঃ দেবখণ্ড, আখেটিকখণ্ড ও বণিকখণ্ড। গ্রন্থটিতে মুকুন্দের "কবিত্বের বিবরণ" অর্থাত আত্মকথা অংশটির দুটি পৃথক রূপ বিভিন্ন পুঁথিতে পাওয়া যায়।
যদি এমন কোন গ্রন্থের নাম করতে হয় যাতে আধুনিক কালের, উপন্যাসের,রস কিছু পরিমাণে মেলে যেমন- নিপুণ পর্যবেক্ষণ, সহৃদয়তা, জীবনে আস্থা, ব্যাপক অভিজ্ঞতা সবই এতে যথোচিত পরিমাণে বর্তমান। মুকুন্দরাম শুদ্ধাচারী বামুন-পণ্ডিতঘরের ছেলে, আজন্ম দেববিগ্রহ সেবক। কিন্তু তার সহানুভূতি থেকে কেউই বঞ্চিত হয়নি - না বনের তুচ্ছতম পশু না জনপদের দুর্গততম মানুষ।সংস্কৃত অলঙ্কার প্রয়োগের পাশাপাশি লোক-ব্যবহার, ছেলেভোলানো, ছেলেখেলা, মেয়েলি ক্রিয়াকাণ্ড, ঘরকন্নার ব্যবস্থা, রান্নাবাড়া ইত্যাদি অনপেক্ষিত সামাজিক ও সাংসারিক ব্যাপারেও বিস্ময়কর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন।
This article uses material from the Wikipedia বাংলা article চণ্ডীমঙ্গল, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.