গ্রিন বুক (ইংরেজি: Green Book) ২০১৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মার্কিন নাট্যধর্মী চলচ্চিত্র। ছবিটি পরিচালনা করেছেন পিটার ফ্যারেলি এবং ফ্রাঙ্ক টনি লিপ ভালেলঙ্গা ও ডন শার্লির সাক্ষাৎকার ও ভালেলঙ্গার স্ত্রীর কাছে লেখা চিঠির ভিত্তিতে এটি রচনা করেছেন পিটার ফ্যারেলি, ব্রায়ান কারি ও নিক ভালেলঙ্গা। ১৯৬০-এর দশকের ডিপ সাউথের পটভূমিতে নির্মিত ছবিটিতে আফ্রো-মার্কিন ধ্রুপদী ও জ্যাজ পিয়ানোবাদক ডন শার্লি (মাহারশালা আলি) ও তার ইতালীয়-মার্কিন গাড়ি চালক ও দেহরক্ষী টনি ভালেলঙ্গা’র (ভিগো মর্টনসন) বিভিন্ন সফরের ঘটনা চিত্রিত হয়েছে। ছবির নামটি নেওয়া হয়েছে ভিক্টর হুগো গ্রিনের বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের আফ্রো-মার্কিন ভ্রমনকারীদের জন্য লেখা দ্য নিগ্রো মটরিস্ট গ্রিন বুক গাইডবই অনুসারে, এই বইটি তাদের বিভিন্ন মোটেল ও রেস্তোরাঁ খুঁজে পেতে সাহায্য করত।
গ্রিন বুক | |
---|---|
Green Book | |
পরিচালক | পিটার ফ্যারেলি |
প্রযোজক |
|
রচয়িতা |
|
শ্রেষ্ঠাংশে |
|
সুরকার | ক্রিস বাউয়ার্স |
চিত্রগ্রাহক | শন পর্টার |
সম্পাদক | প্যাট্রিক জে. ডন ভিটো |
প্রযোজনা কোম্পানি |
|
পরিবেশক | ইউনিভার্সাল পিকচার্স |
মুক্তি |
|
স্থিতিকাল | ১৩০ মিনিট |
দেশ | মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র |
ভাষা | ইংরেজি |
নির্মাণব্যয় | $২৩ মিলিয়ন |
আয় | $৩৭.৬ মিলিয়ন |
গ্রিন বুক ছবিটির উদ্বোধনী প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর টরন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে, সেখানে ছবিটি পিপলস চয়েস পুরস্কার জয় লাভ করে। ছবিটি ইউনিভার্সাল পিকচার্সের পরিবেশনায় ১৬ই নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। মুক্তির পর ছবিটি সমালোচকদের কাছ থেকে ইতিবাচক পর্যালোচনা অর্জন করে, মর্টনসন ও আলির অভিনয় প্রশংসিত হয়, কিন্তু এর ঐতিহাসিক ভুলগুলোর জন্য কিছু নেতিবাচক সমালোচনাও দেখা যায়।
ছবিটি ২০১৮ সালের সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে ন্যাশনাল বোর্ড অব রিভিউ পুরস্কার অর্জন করে এবং আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউট ছবিটিকে বছরের সেরা ১০ চলচ্চিত্রের একটি হিসেবে নির্বাচিত করে। ৯১তম একাডেমি পুরস্কার আয়োজনে ছবিটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র এবং শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা ও শ্রেষ্ঠ মৌলিক চিত্রনাট্যের পুরস্কার লাভ করে। ৭৬তম গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কারে ছবিটি পাঁচটি বিভাগে মনোনয়ন লাভ করে, এবং সেরা সঙ্গীতধর্মী বা হাস্যরসাত্মক চলচ্চিত্র, সেরা পার্শ্ব অভিনেতা ও সেরা চিত্রনাট্যের পুরস্কার অর্জন করে।
সময়টা ১৯৬২ সাল। ডন শার্লি নামের একজন আফ্রিকান-আমেরিকান ক্লাসিক ও জ্যাজ পিয়ানিস্ট পেশাগত কারণে লম্বা এক সফরে বের হবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিড ওয়েস্ট ও ডিপ সাউথে বিভিন্ন রাজ্যে আয়োজিত আট সপ্তাহব্যাপী একটি কনসার্ট ট্যুরে পিয়ানো বাজানোর জন্য তিনি চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন।
সমস্যা হলো সেই সময় কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের সবখানে অবাদ বিচরণের ক্ষেত্রে কিছু বিধি নিষেধ ছিল এবং আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলে সেটি ছিল আরো ভয়াবহ।
ডন শার্লিকে প্রায় দু’মাসব্যাপী রাস্তায় গাড়ি ভ্রমণের মধ্য দিয়ে সেই কনসার্টগুলোতে অংশগ্রহণ করতে হবে, এই কাজের জন্য তাই তিনি একজন দায়িত্ববান ও বিশ্বাসভাজন গাড়িচালকের সন্ধান করতে শুরু করেন।
অন্যদিকে,নিউ ইয়র্কের একটি নাইট ক্লাবে ফ্রাঙ্ক ভালেলঙ্গা নামের এক ইতিলিয়ান-আমেরিকান লোক কাজ করতেন, যদিও তিনি টনি লিপ নামেই সকলের কাছে বেশি পরিচিত ছিলেন। পুনঃসংস্কারের জন্য নাইট ক্লাবটি বন্ধ হয়ে যাওয়াতে তিনি কার্যত বেকার হয়ে যান এবং নতুন চাকরির খুঁজতে থাকেন। আর এভাবেই একদিন শার্লির বাসায় ড্রাইভার হিসেবে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে চলে যান টনি। পরিচয় পর্ব ও টনির অভিজ্ঞতা সম্পর্কে টুকটাক জানার পর শার্লি তাকে বললেন যে, তার আসলে শুধু একজন ড্রাইভার নয় তার বাকি কাজগুলো যেমনঃ জুতো পালিশ, কাপড় ইস্তি করে দিতে পারবে এমন একজন ব্যক্তি দরকার। শার্লির প্রস্তাবে টনি রাজি না হয়ে সোজা সাপটা তাকে বলে দেন যে, তিনি শুধু ড্রাইভারের দায়িত্ব পালন করতে রাজি আছেন; জুতো পালিশ, কাপড় ইস্তি তাকে দিয়ে হবে না। টনি জানতেন, যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাংশের অঞ্চলগুলোতে ভ্রমণ করাটা কতটা ঝামেলাপূর্ণ ও পরিশ্রমের কাজ। তাই তিনি নির্ধারিত পারিশ্রমিক থেকে বেশি দাবি করে বসেন।
টনি মানুষ হিসেবে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ ও সৎ তো ছিলেনই সেই সাথে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মতো সাহস ও বুদ্ধিমত্তাও যে তার ছিল - সে কথা শার্লির কানে এসেছিল। তাই টনির ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ কাজ করছিল তার। তিনি টনিকে ড্রাইভার হিসেবে নিযুক্ত করেন।
আর এভাবেই তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার গায়ে বড় বড় হরফে লেখা বর্ণবাদ ও পৃথকীকরণের মতো নির্মম বাস্তবতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা নির্মল বন্ধুত্বের ও দৃষ্টান্তমূলক মানবতাবাদের রূপরেখা ফুটিয়ে তোলার মধ্যদিয়ে সিনেমার গল্পটি নতুন এক বাঁক নেয়।
সিনেমাতে মূলত ডন শার্লি নামের এক পিয়ানো বাদক ও তার সহচর টনি সড়কপথের দীর্ঘকালীন ভ্রমণ ও ভ্রমণের সময় ঘটে যাওয়া নানা ছোট-বড় ঘটনা, বাধা-বিপত্তি, অতর্কিত ঝামেলা ও যে সমস্ত বাজে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
শার্লি ও টনি নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি ও কৌশল প্রয়োগ করে তাদের ভ্রমণের সুন্দর একটা পরিসমাপ্তি টানেন। তবে যে উপাদানগুলো তাদের গল্পকে একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরার মতো পূর্ণতা দিয়েছিল, সেগুলো ছিল তাদের পারস্পরিক আস্থা, শ্রদ্ধাবোধ ও দায়িত্বশীলতা। সবথেকে বড় ব্যাপার হলো, তাদের দুজনের ব্যক্তিত্বে জেগে ওঠা মনুষ্যত্ববোধ। ভিন্ন শ্রেণী, পেশা, বর্ণ, জাতীয়তা ও রুচির দুজন মানুষ কীভাবে একে অপরের খুব ভালো বন্ধুতে পরিণত হলেন তা সিনেমাটিতে খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।
সিনেমার গল্পটিকে আরও সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করতে হলে প্রথমে সিনেমার নাম অর্থাৎ “গ্রিন বুক” দ্বারা আসলে কী বোঝানো হয়েছে সে ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন। উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে থেকে বিংশ শতাব্দীতে মধ্যভাগ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে “জিম ক্রো” নামে একধরনের পৃথকীকরণ আইন প্রচলিত ছিল। সে আইন মোতাবেক সে অঞ্চলে বসবাসরত অথবা অতিথি হিসেবে আসা কালো বর্ণের মানুষদের কিছু নির্দিষ্ট নীতিমালা মেনে চলতে হতো। মূলত, সাদা বর্ণের মানুষদের সাথে কালোদের বৈষম্য সৃষ্টিকারী আইন ছিল এটি। আর এ আইন দন্ডায়মান থাকাকালীন নিউ ইয়র্ক সিটির মেইল ম্যান ভিক্টর হুগো গ্রিন কালো বর্ণের লোকদের দক্ষিণাঞ্চলে চলাচলের সুবিধার্থে একটি বার্ষিক গাইডবুক প্রকাশ করেন।
১৯৩৬ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকা এ গাইডবুকটিতে আফ্রিকান-আমেরিকান ভ্রমণকারীদের সড়কপথে যাতায়াতের সময় মোটেল ও রেস্টুরেন্ট বেছে নিতে সুবিধা প্রদান করে থাকত। বলে রাখা ভালো, সে যুগে সব রেস্টুরেন্ট অথবা মোটেল কালোদের থাকা-খাওয়ার জন্য উন্মুক্ত ছিল না। তাই কালোদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা আছে এমন কিছু নির্দিষ্ট জায়গার নাম ও ঠিকানাই “দ্য নিগ্রো মোটোরিস্ট গ্রিন বুক” নামের সে গাইডবুকে উল্লেখ করা থাকত। ডন শার্লি যেহেতু একজন আফ্রিকান-আমেরিকান ছিলেন তাই তাকে নিয়ে ট্যুরে বের হওয়ার সময় টনির হাতে তুলে দেওয়া হয় গ্রিন বুকের একটি কপি। আর সেখান থেকে সিনেমার টাইটেল রাখা হয়েছে, “গ্রিন বুক”।
শার্লি ও টনি যাত্রা শুরু করার পর সিনেমার গল্পটি যেন ভিন্ন এক ছন্দে প্রবাহিত হতে থাকে। একইসাথে অনেকটা পথ চলতে হলে দুজন মানুষের মধ্যে যে মতের মিল-অমিল,পরস্পরের আচরণের প্রতি সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি ও পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর আলাদা আলাদা উপায় আছে সেসব একে একে সিনেমার কাহিনীতে চিত্রায়িত করা হয়েছে। শার্লি নিপাট ভদ্রলোক, কখনো কোনো ঝগড়া-বিবাদ অথবা ঝামেলায় জড়াতে পছন্দ করতেন না এবং তিনি ছিলেন একজন সচেতন নাগরিক। অন্যদিকে টনি ছিলেন কথাবার্তায় পটু ও যেকোনো প্রতিকূল পরিবেশকে মাথা ঠান্ডা রেখে হালকা করার ক্ষেত্রে পারদর্শী ব্যক্তি। তবে শার্লির মতো তার আচার-ব্যবহারে তেমন একটা নম্রভাব ছিল না। তাই প্রথমদিকে একে অপরের সাথে নানা ছোটখাট বিষয় নিয়ে বাকবিতণ্ডা বেঁধে যেত। পরে অবশ্য ধীরে ধীরে পথ চলতে চলতে তাদের মধ্যে বেশ ভালো একটা বোঝাপড়া গড়ে ওঠে।
শার্লি যেমন টনির কাছ থেকে জীবনের ছোট ছোট মুহূর্তগুলোকে উপভোগ করতে শিখেছিলেন, ঠিক তেমনি টনিও শার্লির কাছ থেকে অনেক নতুন গুণ রপ্ত করেছিলেন। টনির কাছ থেকে শার্লি বাইরের দুনিয়ার নিষ্ঠুরতার কথা জানতে পারেন, আর শার্লির কাছ থেকে টনি শেখেন গুছিয়ে নিজের মনের কথা প্রকাশের ভাষা।
সেই যাত্রাপথে শার্লি ও টনি একটি ব্যাপার খুব কাছ থেকে আবিষ্কার করেন। সেটা হচ্ছে, সমাজ ব্যবস্থার গোড়ামি। শার্লির মতো বিত্তশালী ও গুণী ব্যক্তিও শুধু কালো চামড়াধারী হওয়াতে সমাজের উচ্চপদস্থ মানুষের সাথে বসে খেতে পারবেন না এবং সাদা চামড়ার লোকজন দ্বারা প্রতি পদে পদে অপদস্থ হবার সম্ভাবনা তো আছেই। অনেক শিক্ষিত লোকও যেখানে বর্ণবাদী আচরণ করে থাকেন,সেখানে টনির মতো অল্প শিক্ষিত খেটে খাওয়া লোকের অন্তরে বর্ণবাদের ছিটেফোঁটাও ছিল না। সমাজের উঁচু স্তরের মানুষদের সাথে মেলামেশা করেও শার্লি টনির দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেন, টনিও নিজের ছোট দুনিয়ার সাথে শার্লির পরিচয় করিয়ে দেন।
সিনেমাটির সবচেয়ে চমকপ্রদ দিক হচ্ছে, অনেক হাস্যরস ও মজাদার ঘটনার মধ্য সমকামিতা, বর্ণবাদ ও পৃথকীকরণের মত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়গুলো খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। দুজন ভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ডের মানুষের স্বার্থহীন বন্ধুত্বের সম্পর্ক খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
কনসার্ট শেষ করে ফেরার পথে টনি একটু অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। শার্লি তখন নিজে গাড়ি চালিয়ে টনিকে তার বাসায় পৌঁছে দেন। ক্রিস্টমাসের দিন শার্লি টনিকে চমকে দিয়ে তার বাসায় গিয়ে উপস্থিত হন। টনির স্ত্রী ডোলোরসকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, "আপনার স্বামীকে আমার সাথে শেয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ"।
সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত এ সিনেমাটির চিত্রনাট্য মূলত বাস্তবের ডন শার্লি ও টনি লিপের সাক্ষাৎকার ও সে সময়ে টনির নিজের স্ত্রীর কাছে পাঠানো কিছু চিঠির ভিত্তিতে সাজানো হয়েছে। সিনেমার তিনজন চিত্রনাট্যকারের মধ্যে একজন তো ছিলেন খোদ টনি লিপের ছেলে নিক ভালেলঙ্গা। বাকি দুই চিত্রনাট্যকার হলেন পিটার ফ্যারেলি ও ব্রায়ান হেইস কারি। তাদের মধ্যে পিটার ফ্যারেলি সিনেমাটি পরিচালনার দায়িত্বেও ছিলেন।
This article uses material from the Wikipedia বাংলা article গ্রিন বুক (চলচ্চিত্র), which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.