সুসমাচার

সুসমাচার (প্রাচীন গ্রিক: Εὐαγγέλιον; লাতিন: Bona annuntiatio; হিব্রু ভাষায়: בשורות‎; আরবি: إنجيل; প্রাচীন ইংরেজি: Gōdspel‎; ইংরেজি: Gospel) বলতে মূলত খ্রিস্টান বার্তা বোঝানো হত, কিন্তু দ্বিতীয় শতাব্দীতে এসে এটি সেই পুস্তকগুলির জন্যও ব্যবহৃত হতে থাকে যার মাধ্যমে বার্তাটি প্রচার করা হত; এই অর্থে একটি সুসমাচারকে নাসরতীয় যীশুর কথা ও কাজের উপাখ্যানপূর্ণ বর্ণনার, তাঁর বিচার ও মৃত্যু এবং তাঁর পুনরুত্থানোত্তর আবির্ভাবের বিভিন্ন প্রতিবেদনের মাধ্যমে সমাপ্ত, একটি আলগা বুনন হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে।

সুসমাচার
আর্মেনীয় ভাষায় রচিত সাধু মার্ক লিখিত সুসমাচারের প্রথম পৃষ্ঠা। সার্গিস পিটস্যাককৃত, ১৪শ শতাব্দী।

সাধু মথি, মার্ক, লূকযোহন লিখিত চারটি ধর্মসম্মত সুসমাচার অভিন্ন মৌলিক রূপরেখা ভাগ করে নেয়: যীশু বাপ্তিস্মদাতা যোহনকে সাথে নিয়ে পরিচর্যা শুরু করেন, শিষ্যদের ডাকেন, শিক্ষা দেন ও সুস্থ করেন এবং ফরীশীদের মুখোমুখি হন, ক্রুশারোপিত হয়ে মারা যান এবং মৃতদের মধ্য থেকে পুনরুত্থিত হন। প্রত্যেকটিরই যীশু ও তাঁর ঐশ্বরিক ভূমিকা সম্বন্ধে নিজস্ব স্বতন্ত্র ধারণা রয়েছে: মার্ক কখনো তাঁকে “ঈশ্বর” বলেন না, লূক কিছু অনুচ্ছেদ সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেললেও মার্ককে প্রসারিত করেন, কিন্তু তবুও মথির চেয়ে বিশ্বস্তভাবে তাঁর পটভূমি অনুসরণ করেন এবং যোহন, সবচেয়ে স্পষ্টত ধর্মতাত্ত্বিক, যীশুর জীবনের বর্ণনার প্রেক্ষাপটের বাইরে প্রথম খ্রিস্টীয় বিচার প্রয়োগ করেন। এগুলোর মধ্যে এমন বিবরণ রয়েছে যা অসামঞ্জস্যবিধানযোগ্য এবং তাদের সমন্বয় করার প্রচেষ্টা তাদের স্বতন্ত্র ধর্মতাত্ত্বিক বার্তাগুলির জন্য বিঘ্ন সৃষ্টি করবে। এগুলি সম্ভবত ৬৬ ও ১১০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে লেখা হয়েছিল। চারটি সুসমাচারই বেনামি ছিল (আধুনিক নামগুলো দ্বিতীয় শতাব্দীতে যোগ করা হয়েছিল), প্রায় কোনো প্রত্যক্ষদর্শী ছিল না এবং সবগুলিই দীর্ঘ মৌখিক ও লিখিত প্রেষণের শেষ ফলাফল। বিভিন্ন সূত্র ব্যবহার করে মার্কই প্রথম লেখা হয়েছিল; মথি ও লূকের লেখকরা স্বাধীনভাবে কার্যনির্বাহী করে মার্ককে যীশুর কবরণের জন্য ব্যবহার করেছিলেন, এটিকে কিউ ডকুমেন্ট নামক বাণীসংগ্রহ ও অনন্য অতিরিক্ত উপাদানের সাথে সম্পূরক করেছিলেন; এবং একটি কাছাকাছি ঐকমত্য আছে যে যোহনের উৎপত্তি একটি “লক্ষণ” উৎস (বা সুসমাচার) হিসাবে ছিল যা একটি যোহনীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচারিত হয়েছিল। প্রথম তিনটি ও যোহনের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও অসঙ্গতি উভয় ঐতিহ্যকে সমানভাবে নির্ভরযোগ্য হিসাবে গ্রহণ করা অসম্ভব করে তোলে। আধুনিক পণ্ডিতগণ সুসমাচারগুলোর উপর অযৌক্তিকভাবে নির্ভর করার ব্যাপারে সতর্ক, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা যীশুর জনসম্পৃক্ত কর্মজীবন সম্পর্কে একটি ভালো ধারণা প্রদান করে এবং সমালোচনামূলক অধ্যয়ন পরবর্তী লেখকদের থেকে যীশুর মৌলিক ধারণাগুলিকে আলাদা করার চেষ্টা করতে পারে।

অনেক অধর্মসম্মত সুসমাচারও লেখা হয়েছিল, সবগুলো চারটি ধর্মসম্মত সুসমাচারের পর এবং তাদের মতো তাদের বিভিন্ন লেখকের বিশেষ ধর্মতাত্ত্বিক মতামতকে সমর্থন করে। গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণগুলির মধ্যে রয়েছে থোমা লিখিত সুসমাচার, পিতর লিখিত সুসমাচার, যিহূদা লিখিত সুসমাচার, মরিয়ম লিখিত সুসমাচার, শৈশবকালীন সুসমাচার যেমন যাকোব লিখিত সুসমাচার (মরিয়মের চিরস্থায়ী কুমারীত্বের প্রথম পরিচায়ক) এবং দিয়াতেসারনের মতো সুসমাচার সঙ্গতি।

খ্রিস্টধর্মে ধর্মসম্মত সুসমাচারগুলিরই মর্যাদা বেশি। এগুলিকে ঈশ্বর-কর্তৃক প্রকাশিত মনে করা হয়। এগুলি খ্রিস্টধর্মের ধর্মীয় ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু। চারটি ধর্মসম্মত সুসমাচারে প্রকাশিত খ্রিস্টের জীবনকথাই যথাযথ ও প্রামাণ্য বলে খ্রিস্টানদের বিশ্বাস। তবে অনেক গবেষকের মতে, এই চারটি সুসমাচারের সবকিছু ঐতিহাসিকভাবে বিশ্বাসযোগ্য নয়।

ইসলামে ইঞ্জিল (আরবি: إنجيل) নামে একটি আসমানী কিতাবের উল্লেখ আছে। ইসলাম মতে, এই বইটি আল্লাহ নবী ঈসার উপর নাজিল করেছিলেন। ইঞ্জিল শব্দটি কোনো কোনো অনুবাদে ‘গসপেল’ অর্থাৎ সুসমাচার হয়েছে। কুরআনে যে চারটি বইকে আল্লাহ্‌-কর্তৃক প্রকাশিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে, এটি তার একটি। তবে ইসলাম অনুসারে, পরবর্তী যুগে ইঞ্জিলের কথা পাল্টে দেওয়া হয়েছিল। তাই আল্লাহ নবী মুহাম্মদকে পাঠিয়েছিলেন সর্বশেষ কিতাব কুরআন প্রকাশ করার জন্য।

ব্যুৎপত্তি

ইংরেজি "Gospel" শব্দটি এসেছে প্রাচীন ইংরেজি gōd-spell (বা অপেক্ষাকৃত কম ব্যবহৃত godspel) কথাটি থেকে। এর অর্থ "শুভ সংবাদ" বা "আনন্দ তরঙ্গ"। সুসমাচারকে মসিহার আসন্ন রাজ্যের "শুভ আগমনবার্তা" মনে করা হয়। এখানে খ্রিস্টানদের প্রধান মতবাদের কেন্দ্রবিন্দু যিশুর জীবন ও মৃত্যুর মাধ্যমে পাপমুক্তি ও শয়তানের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কথা বলা হয়েছে।

"গসপেল" কথাটি হল গ্রিক "εὐαγγέλιον" বা "ইউয়ানজেলিয়ন" ("শুভ সংবাদ") অথবা আরামাইক "ܐܘܢܓܠܝܘܢ" বা "ইউয়াংএলিয়াওন" কথাটির আক্ষরিক অনুবাদ। গ্রিক "ইউয়ানজেলিয়ন" (এর এর লাতিন প্রতিরূপ evangelium বা "ইভানগেলিয়াম") শব্দটি থেকে ইংরেজিতে "এভানজেলিস্ট" বা "ইভানজেলিজম"-এর উৎপত্তি। চারটি শাস্ত্রীয় খ্রিস্টান সুসমাচারের লেখকদের বলা হয় চার ইভানজেলিস্ট।

ব্যবহার

পল করিন্থের চার্চের লোকেদের কাছে "εὐαγγέλιον" (সুসমাচার) শব্দটি প্রথম ব্যবহার করে বলেছিলেন, "বন্ধুগণ, আমি যে সুসমাচার তোমাদের কাছে প্রচার করছি, যা তোমরা গ্রহণ করেছ এবং যার উপরে তোমরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছ, তার কথাই আমি তোমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।" সাহিত্যের একটি বর্গ হিসেবে "গসপেল" কথাটির প্রথম প্রয়োগ ঘটেছিল দ্বিতীয় শতাব্দীতে। জাস্টিন মার্টায়ার (১৫৫ খ্রিষ্টাব্দ) তার অ্যাপোলজি-তে লিখেছিলেন, "...প্রেরিতেরা তাঁদের স্মৃতিকথায় যা লিখেছিলেন, তা গসপেল নামে পরিচিত।"

সাধারণত, প্রাচীন খ্রিস্টীয় সাহিত্যে "গসপেল" ছিল একটি বিশেষ বর্গের নাম। যেগুলি শাস্ত্রীয় সুসমাচারের মর্যাদা পায়নি, সেগুলিও প্রাচীন খ্রিস্টধর্মের যুগে প্রচলিত ছিল। টমাসলিখিত সুসমাচার সহ এইরকম অনেকগুলি গসপেলেই সুসমাচারের পরিচিত কাঠামোটি দেখা যায় না।

প্রাথমিক বিবরণ

বাইবেল-বিশেষজ্ঞদের মতে, যিশু সম্পর্কে লোকমুখে প্রচলিত গল্প ও কয়েকটি বিবরণীর সংকলন শাস্ত্রীয় সুসমাচারগুলির আগেই রচিত হয়েছিল। লূকলিখিত সুসমাচারের উৎসর্গ পৃষ্ঠার ভূমিকাটি থেকে জানা যায়, উক্ত সুসমাচারটি রচনার আগেই যিশু সম্পর্কে অনেক গল্প রচিত হয়েছিল। লুক যে শব্দটি (διήγησις diēgēsis) ব্যবহার করেন, সেটি একটি প্রাচীন গ্রিক শব্দ। সেটি ব্যবহৃত হত ঐতিহাসিক আখ্যান অর্থে।

"গসপেল" শব্দটি নূতন নিয়মের কোনো শাস্ত্রীয় সুসমাচারে ব্যবহৃত হয়নি। তবে পরবর্তীকালের একটি প্রথাগত পাঠ অনুযায়ী লূকলিখিত সুসমাচারে সুসমাচারের উল্লেখ দেখা যায়।

ঐক্যমূলক সুসমাচার

ম্যাথিউ, মার্ক ও লুকের সুসমাচারগুলিকে ঐক্যমূলক সুসমাচার বা সাইনপটিক মনে করা হয়। কারণ, এগুলির মধ্যে কিছু কিছু মিল পাওয়া যায় যা জনের সুসমাচারের মধ্যে পাওয়া যায় না। "সাইনপটিক" বলতে বোঝানো হয়েছে যা একসঙ্গে দেখা বা পড়া হয়েছে, যার অর্থ এই তিন সুসমাচারে অনেক ঘটনার মিল আছে। ঐক্যমূলক সুসমাচারগুলি অনেক জনপ্রিয় গল্প, উপকথা ও উপদেশের উৎস। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য যিশুর জন্ম, যিশুর শৈলোপদেশ, শেষ নৈশভোজ ইত্যাদি।

মনে করা হয়, তিনটি ঐক্যমূলক সুসমাচার একটি সাধারণ উৎস ও একাধিক উৎস থেকে তথ্য ধার করে লেখা হয়েছিল এবং এগুলি একে অপরকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। যেমন মার্কের সুসমাচারের অনেকটাই লুক বা ম্যাথিউর সুসমাচারে পাওয়া যায়। এর ফলে অনুমিত হয় যে মার্ক ম্যাথিউ ও লুকের থেকে তথ্য নিয়ে সুসমাচারটি লিপিবদ্ধ করেন। তবে ম্যাথিউ ও লুকের সুসমাচারে বর্ণিত সাধারণ ঘটনা যেখানে মার্কের সুসমাচারে নেই, তা নির্দেশ করে যে, উক্ত দুই সুসমাচারের তথ্যের উৎস আলাদা ছিল।

চতুর্থ সুসমাচার বা জনের লেখা সুসমাচারটি যিশুর জীবন ও তার পার্ষদদের অন্যরকম বর্ণনা দেয়। এই ধরনের পার্থক্যের জন্য গবেষকেরা সুসমাচারের বর্ণনাগুলির সত্যতাকে সন্দেহের চোখে দেখেন। তবে সাধারণভাবে ঐক্যমূলক সুসমাচার ও যিশুর সম্পর্কে অন্যান্য নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যগুলিকে তারা সত্যই মনে করেন।

তথ্যসূত্র

McGrath, A. 2001. In the Beginning the Story of the King James Bible and how it changed a Nation, a Language and a Culture. Hodder & Stoughton. আইএসবিএন ০-৩৪০-৭৮৫৮৫-৩.

বহিঃসংযোগ

Tags:

সুসমাচার ব্যুৎপত্তিসুসমাচার ব্যবহারসুসমাচার প্রাথমিক বিবরণসুসমাচার ঐক্যমূলক সুসমাচার তথ্যসূত্রসুসমাচার আরও পড়ুনসুসমাচার বহিঃসংযোগসুসমাচারআরবি ভাষাইংরেজি ভাষাখ্রিস্টাননাসরৎপ্রাচীন ইংরেজিপ্রাচীন গ্রিকযীশুযীশুর পুনরুত্থানলাতিন ভাষাহিব্রু ভাষা

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবএ. পি. জে. আবদুল কালামফাতিমাকারকশিল্প বিপ্লবসাঁওতালপ্রিমিয়ার লিগকালেমাবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়রশ্মিকা মন্দানাধর্মউটের যুদ্ধগোপাল ভাঁড়জাপানদারুল উলুম দেওবন্দকামদা একাদশীরাধাজন্ডিসবিদায় হজ্জের ভাষণতানজিন তিশাকুমিল্লাকানাডামুসাসানি লিওনবিতর নামাজবাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলবিদ্যালয়ম্যালেরিয়াইলন মাস্কআকিজ গ্রুপআসসালামু আলাইকুমমুজিবনগর সরকারসিরাজগঞ্জ জেলাকাশ্মীরহামপাল সাম্রাজ্যবাংলাদেশসৈয়দ মুজতবা আলীতাজউদ্দীন আহমদঅ্যান্টিবায়োটিক তালিকাপান (পাতা)মান্নানিম২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপবঙ্গবন্ধু সেতুপ্রথম ওরহানখন্দকের যুদ্ধস্পিন (পদার্থবিজ্ঞান)জবাভরিজরায়ুইউরোইন্দোনেশিয়াবাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনক্ষুদিরাম বসুদীনবন্ধু মিত্রউইকিপিডিয়াসুকুমার রায়বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামযুক্তরাজ্যলালনকাজী নজরুল ইসলামধর্ষণবাংলাদেশের প্রশাসনিক অঞ্চলমুখমৈথুননরসিংদী জেলালোকসভা কেন্দ্রের তালিকাব্র্যাক ব্যাংক পিএলসিঅণুজীবভগবদ্গীতাসুফিয়া কামালতাপপ্রবাহকুয়েতবাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, ২০২৩পদ্মা সেতুসিলেট বিভাগরয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর🡆 More