পদ্মানদীর মাঝি ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত একটি উপন্যাস। প্রকাশকালের আনুমানিক হিসাবে পুতুলনাচের ইতিকথাকে তৃতীয় উপন্যাস ধরলে পদ্মানদীর মাঝি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চতুর্থ উপন্যাস। উপন্যাসটি ১৯৩৪ সাল থেকে পূর্বাশা পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে এবং ১৯৩৬ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
লেখক | মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় |
---|---|
ভাষা | বাংলা |
বিষয় | উপন্যাস |
ধরন | আঞ্চলিক উপন্যাস |
প্রকাশক | গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স (কলকাতা) |
প্রকাশনার তারিখ | জ্যৈষ্ঠ, ১৩৪৩/ ২৮ মে ১৯৩৬ |
পৃষ্ঠাসংখ্যা | ২১২ |
উপন্যাসটি কলকাতা থেকে সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত পূর্বাশা মাসিক পত্রিকায় জ্যৈষ্ঠ ১৩৪১ থেকে শ্রাবণ ১৩৪২ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে নয় কিস্তি ছাপার পর প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। এক বছর পর ১৯৩৬-এর মে মাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। পূর্বাশা পত্রিকায় ছাপার সময় দেবীগঞ্জ ও আমিনবাড়ির এই দুটি স্থানের নাম ছিল যথাক্রমে গোয়ালন্দ ও রাজবাড়ী।
পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসের পটভূমি বাংলাদেশের বিক্রমপুর-ফরিদপুর অঞ্চল। এই উপন্যাসের দেবীগঞ্জ ও আমিনবাড়ি পদ্মার তীরবর্তী গ্রাম। উপন্যাসে পদ্মার তীর সংলগ্ন কেতুপুর ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের পদ্মার মাঝি ও জেলেদের বিশ্বস্ত জীবনালেখ্য চিত্রিত হয়েছে। পদ্মা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী। এর ভাঙন প্রবণতা ও প্রলয়ংকরী স্বভাবের কারণে একে বলা হয় 'কীর্তিনাশা' বা রাক্ষুসী পদ্মা। এ নদীর তীরের নির্দিষ্ট কোন সীমারেখা নেই। শহর থেকে দূরে এ নদী এলাকার কয়েকটি গ্রামের দীন-দরিদ্র জেলে ও মাঝিদের জীবনচিত্র এতে অঙ্কিত হয়েছে। জেলেপাড়ারর মাঝি ও জেলেদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না-অভাব-অভিযোগ - যা কিনা প্রকৃতিগতভাবে সেই জীবনধারায় অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ তা এখানে বিশ্বস্ততার সাথে চিত্রিত হয়েছে। তাদের প্রতিটি দিন কাটে দীনহীন অসহায় আর ক্ষুধা-দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে। দুবেলা দুমুঠো খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাটাই যেন তাদের জীবনের পরম আরাধ্য। এটুকু পেলেই তারা খুশি।
সব কটি চরিত্রই যেন এই উপন্যাসের পটভূমি এবং সমাজের বাসিন্দাদের অকৃত্রিম রূপায়ন। আশ্চর্য এবং অদ্ভুত শৈল্পিক সৌকর্য ও পরিমিতি দিয়ে লেখক অতি যত্নসহকারে চরিত্রগুলো গড়ে তুলেছেন। এরা এ সমাজের একেবারেই খাঁটি ও অকৃত্রিম চরিত্র। তারা একান্তভাবেই যেন এই সমাজের উপযুক্ত।
কুবের উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র কুবের। কুবের এ উপন্যাসের নায়কও। সংসারের অভাব-দারিদ্র্য ও দুঃখ-বেদনাদগ্ধ কুবের এক দিকে যেমন তার সংসারের অভিভাবক, তেমনি সে চিরপঙ্গু মালার স্বামী, অন্য দিকে সে তার সন্তানদের স্নেহময় পিতা। শহর থেকে দূরে পদ্মানদীর তীরে অবস্থিত অজগ্রাম কেতুপুরের সে বাসিন্দা। পদ্মা নদীর সে এক পাকা মাঝি। সে নদীতে তার অন্যান্য সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে মাছ ধরে, বিশেষত ইলিশ মাছ ধরে সে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করে।
কপিলা এ উপন্যাসের নায়িকা কপিলা। ব্যক্তিগত পরিচয়ে সে মালার বোন, সাংসারিক পরিচয়ে সে এক জনের স্ত্রী। মালার মত সে পঙ্গু নয়। পুরুষের হৃদয়ে আদিম আবেদন সৃষ্টিকারী কপিলা কুবেরের সাথে যেন উদাসীনভাবে প্রেমের অভিনয় করে যায়। তার স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় সে বাপের বাড়িতে চলে আসে। বন্যার সময় সে কিছুদিন থাকে কেতুপুরে কুবেরে বাড়িতে।
হোসেন মিয়া 'পদ্মানদীর মাঝি' উপন্যাসের রহস্যময় অথচ গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রধান চরিত্র হোসেন মিয়া। নোয়াখালীর এই লোকটি বহুদর্শী ও বহু অভিজ্ঞ এক ব্যক্তি। কেতুপুর এলাকায় প্রথমে তাকে দীনহীন ও কপর্দকসশূন্য এক ব্যক্তিরূপে দেখা গিয়েছিল।
কুবের, কপিলা ও হোসেন মিয়া ছাড়াও আরও কয়েকটি চরিত্র এই উপন্যাসে রয়েছে। যেমন- রাসু, ধনঞ্জয়, পীতম মাঝি, মালা, গণেষ, আমিনুদ্দি, রসুল, ফাতেমা প্রভৃতি চরিত্র। এ সব চরিত্রাবলিরর সমন্বয়ে এ উপন্যাসটিতে একটি সার্থক সমাজচিত্র অঙ্কনের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
পদ্মানদীর মাঝি বাংলা সাহিত্যের একটি বিশিষ্ট আঞ্চলিক উপন্যাস। অলঙ্কার শাস্ত্রে আঞ্চলিক উপন্যাসের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সে অনুসারে সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় যে, এটি একটি সার্থক আঞ্চলিক উপন্যাস। উপন্যাসের আঙ্গিক গঠন, রচনাশৈলী, পাত্র-পাত্রীদের মুখে আরোপিত ভাষা, জীবনাচরণ, জীবনচর্চা এ সবই আঞ্চলিক উপন্যাসেরই পরিচয়বাহী। এ সকল কারণে উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্টতার দাবিদার এবং এ উপন্যাসের জগৎ বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে সম্পূর্ণ এক অজানা বস্তু বলে মনে হয়। নানা কারণে উপন্যাসটি জনপ্রিয়তার শীর্ষে আরোহণ করে। এই উপন্যাসটির জনপ্রিয়তার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিশিষ্ট সমালোচক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তার বঙ্গ সাহিত্য উপন্যাসের ধারা গ্রন্থে লিখেছেন-
ইহার একটি কারণ অবশ্য বিষয়ের অভিনবত্ব - পদ্মানদীর মাঝিদের দুঃসাহসিক ও কতকটা অসাধারণ জীবনযাত্রারও আকর্ষণী শক্তি। দ্বিতীয় কারণ, পূর্ববঙ্গের সরস ও কৃত্রিমতা বিবর্জিত কথ্য ভাষার সুষ্ঠু প্রয়োগ। কিন্তু উপন্যাসটির সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ হইতেছে ইহা সম্পূর্ণরূপে নিম্নশ্রেণী অধ্যুষিত গ্রাম্য জীবনের চিত্রাঙ্কনে সূক্ষ্ম ও নিখুঁত পরিমিতিবোধ, ইহার সঙ্কীর্ণ পরিধির মধ্যে সনাতন মানব-প্রবৃত্তিগুলির ক্ষুদ্র সংঘাত ও মৃদু উচ্ছ্বাসের যথাযথ সীমা নির্দেশ।
জেলে অধ্যুষিত গ্রামের জীবনযাত্রাই পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসটির মূল উপজীব্য। এখানকার সমস্ত কিছুই যেন পরিচালিত হয় প্রকৃতির অমোঘ নির্দেশে। পদ্মা নদীর তীরবর্তী কেতুপুর সংলগ্ন যে এলাকাটির মানুষের জীবনচিত্র এখানে অঙ্কিত হয়েছে, তা সম্পূর্ণভাবে বাইরের সম্পর্ক বিবর্জিত। এই আঞ্চলিক উপন্যাসটির সার্থকতা বিষয়ে সমালোচকের এই উক্তিও সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য। এ উপন্যাসটির কোথাও "এই ধীবর পল্লীর জীবনযাত্রায় শিক্ষিত আভিজাত্যের মার্জিত রুচি ও উচ্চ আদর্শবাদের ছায়াপাত নাই। " এ উপন্যাসটির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সমালোচক যথার্থই বলেছেন—
অধিবাসীদের ঈর্ষা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রীতি, সমবেদনা, চক্রান্ত, দলাদলি সমস্তই বাহিরের মধ্যস্ততা ছাড়া নিজ প্রকৃতি নির্ধারিত সঙ্কীর্ণ কক্ষপথে আবর্তিত হইয়াছে। একটি সুখপাঠ্য, সার্থক ও বিশিষ্ট আঞ্চলিক উপন্যাস হিসেবে এখানেই এর সার্থকতা।
উপন্যাসটির প্রথম অনুবাদটি হয় ইংরেজি ভাষায় 'বোটম্যান অব দ্য পদ্মা' নামে। হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় কর্তৃক উপন্যাসের প্রথম এ অনুবাদটি ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯৫৩ ও ১৯৫৪ সালে যথাক্রমে সুইডিশ ও চেক ভাষায় উপন্যাসটির নব্য অনুবাদ প্রকাশিত হয়। এছাড়াও পরবর্তীতে ভারতের একাধিক প্রাদেশিক ভাষাসহ হাঙ্গেরীয়, রুশ, লিথুয়ানীয়, নরওয়েজীয়, সুইডিশ, জার্মান ও ওলন্দাজ ভাষায়ও বিভিন্ন লেখক এবং প্রকাশক কর্তৃক উপন্যাসটির অনুবাদ প্রকাশিত হয়।
পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র জাগো হুয়া সাভেরা। এটি পাকিস্তানি চলচ্চিত্র পরিচালক আখতার জং কারদার পরিচালিত ১৯৫৯ সালের পাকিস্তানি চলচ্চিত্র। ছবিটির চিত্রনাট্য রচনা করেছেন ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ। এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন আনিস, তৃপ্তি মিত্র, কাজী খালেক, জুরাইন লক্ষ্মী, ও মীনা লতিফ প্রমূখ।
লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যেহেতু হিন্দু ও ভারতীয়, তাই উক্ত চলচ্চিত্রে তাঁর নাম ব্যবহৃত হয়নি। এর বদলে কাহিনীকার হিসেবে উর্দু ভাষার বিশিষ্ট কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজের নাম উল্লেখ করা হয়। এ জন্য ফয়েজ আহমদ ফয়েজকে প্রচুর সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। তিনি অবশ্য গান ও সংলাপ বলার দায়িত্ব পালন করেন।
মানিক বন্ধ্যোপাধায়ের 'পদ্মানদীর মাঝি' উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত দ্বিতীয় চলচ্চিত্রটি পদ্মা নদীর মাঝি, যেটা ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ এবং ভারতের যৌথ প্রযোজনায় বাংলা ভাষায় মুক্তি পায়। উপন্যাস অবলম্বনে গৌতম ঘোষ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। এতে অভিনয় করেন - রাইসুল ইসলাম আসাদ, চম্পা, রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত প্রমূখ।
This article uses material from the Wikipedia বাংলা article পদ্মানদীর মাঝি (উপন্যাস), which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.