কুরবানী (আরবি: قربانى), কুরবান অথবা আদ্বহা বা আযহা ( أضحية) কে ইসলামী আইন হিসাবে উল্লেখ করা হয়, যা ঈদ উল আযহার সময় পশু উৎসর্গের অনুষ্ঠান। ইসলামি মতে কুরবানী হচ্ছে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট ব্যক্তির আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পুরস্কার লাভের আশায় নির্দিষ্ট পশু জবেহ করা। মুসলমানদের পবিত্র আল কোরআনের তিনটি স্থানে কুরবানির উল্লেখ আছে যার একটি পশু কুরবানির ক্ষেত্রে এবং বাকি দুটি সাধারণ ভাবনার কাজ বোঝাতে যা দ্বারা আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া যায়। জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১২ তারিখ সন্ধ্যাা পর্যন্ত আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য পশু জবাই করাকে ইসলামে কুরবানি বলে।
কুরবানী শব্দটি হিব্রু কোরবান (קרבן) আর সিরিয়াক ভাষার কুরবানা শব্দদুটির সংগে সম্পর্কিত যার আরবী অর্থ "কারো নিকটবর্তী হওয়া"।
ইসলামে কুরবানীর ইতিহাস বেশ প্রাচীন। আল কুরআনে হাবিল এবং কাবিলের উল্লেখ পাওয়া যায়। হাবিল প্রথম মানুষ যে আল্লাহর জন্য একটি পশু কুুরবানী করেন । ইবনে কাসির বর্ণনা করেছেন যে, হাবিল একটি ভেড়া এবং তার ভাই কাবিল তার ফসলের কিছু অংশ স্রষ্টার উদ্দেশ্যে নিবেদন করে। আল্লাহর নির্ধারিত পদ্ধতি ছিল যে আগুন আকাশ থেকে নেমে আসবে এবং গ্রহণযোগ্য কুরবানী গ্রহণ করবে। তদনুসারে, আগুন নেমে আসে এবং হাবিলের জবেহকৃত পশুটির কুরবানী গ্রহণ করে। অন্যদিকে কাবিলের ফসল কুরবানী প্রত্যাখ্যান করে। কাবিল এই ঘটনায় ঈর্ষান্বিত হয় ও সামাজিভাবে অপমানবোধ করে কুরবানী কবুল না হওয়ার বিষয়টি তার ভাই হাবিলকে হত্যা করে, যা মানব ইতিহাসের প্রথম হত্যাকাণ্ড হিসেবে পরিচিত। কাবিল তার কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত না হওয়ায় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেননি।
ইসলামের বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী, মহান আল্লাহ তা’আলা ইসলামের রাসুল হযরত ইব্রাহীম কে স্বপ্নযোগে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি কুরবানি করার নির্দেশ দেনঃ “তুমি তোমার প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে কোরবানি কর”। ইব্রাহীম স্বপ্নে এ আদেশ পেয়ে ১০টি উট কোরবানি করলেন। পুনরায় তিনি একই স্বপ্ন দেখলেন। ইব্রাহীম আবার ১০০টি উট কোরবানি করেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] এরপরেও তিনি একই স্বপ্ন দেখে ভাবলেন, আমার কাছে তো এ মুহূর্তে প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.) ছাড়া আর কোনো প্রিয় বস্তু নেই। তখন তিনি পুত্রকে কোরবানির উদ্দেশ্যে আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। যখন ইব্রাহীম আরাফাত পর্বতের উপর তাঁর পুত্রকে কোরবানি দেয়ার জন্য গলদেশে ছুরি চালানোর চেষ্টা করেন, তখন তিনি বিস্মিত হয়ে দেখেন যে তাঁর পুত্রের পরিবর্তে একটি প্রাণী কোরবানি হয়েছে এবং তাঁর পুত্রের কোন ক্ষতি হয়নি। এই ঘটনাকে স্মরণ করে সারা বিশ্বের মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রতি বছর এই দিবসটি ঈদ উল আধহা নামে উদ্যাপন করে।
ইসলামে, হিজরী ক্যালেন্ডারের ১২ তম চন্দ্র মাসের জিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত কুরবানী করার সময় হিসেবে নির্ধারিত। এ দিনে বিশ্ব জুড়ে মুসলমানরা কুরবানী দেয় যার অর্থ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার খুুুশীর জন্য নির্দিষ্ট দিনে একটি পশুকে জবেহ করা। ইহা পুত্রের পরিবর্তে ইব্রাহিমের একটি মেষের আত্মত্যাগের পুনরাবৃত্তি, যা ইহুদীধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা এবং ইসলাম বিশ্বাস করে ঘটনাটিকে। এ উপলক্ষ্যে ইসলামি ধর্মপ্রচারকগণ উক্ত ঘটনাটির উল্লেখকরে মানবতায় সেবায় মুসলমানদেরকে তাদের সময়, প্রচেষ্টা এবং সম্পদ নিয়ে এগিয়ে আসতে উজ্জীবিত করে থাকে।
ফিকহের শাখা মেনে নেয় যে পশুটিকে অবশ্যই জবেহর নিয়ম মেনে হত্যা করতে হবে এবং পশুটি একটি গৃহপালিত ছাগল, ভেড়া, গরু বা উট হতে হবে।
ইসলামের জন্য শহীদ হওয়া বোঝাতে কুরবানী শব্দটি ব্যবহৃত হয়। আবার ব্যক্তির সম্পদ ধর্মীয় উদ্দেশ্যে বিলিয়ে দেওয়াকে আল্লাহর রাস্তায় কুরবানী বলা হয়ে থাকে।
মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কোরআন শরীফে কুরবানী সম্পর্কে একাধিক সুরায় উল্লেখ আছে:
অতএব হে মানুষ! আল্লাহ-সচেতন হও। আল্লাহর ধর্মবিধান লঙ্ঘন হতে দূরে থাকো। জেনে রাখো, আল্লাহ মন্দ কাজের শাস্তিদানে কঠোর।
— সূরা বাকারা, আয়াত ১৯৬
হে নবী! কিতাবিগণকে আদমের দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের ঘটনা ভালো করে বর্ণনা করো। তারা যখন কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো। কিন্তু অন্যজনের কোরবানি কবুল হলো না। ক্ষিপ্ত হয়ে সে বলল, আমি তোমাকে খুন করবো। অপরজন বলল, প্রভু তো শুধু আল্লাহ-সচেতনদের কোরবানিই কবুল করেন।
— সূরা মায়েদা, আয়াত-২৭
হে নবী! ওদের বলুন, আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ-আমার সবকিছুই বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে। তিনি একক ও অদ্বিতীয়। এ আদেশই আমি পেয়েছি। আমি সমর্পিতদের মধ্যে প্রথম।
— সূরা আনআম, আয়াত ১৬২-১৬৩
আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্যে কোরবানিকে ইবাদতের অংশ করেছি। যাতে জীবনোপকরণ হিসেবে যে গবাদি পশু তাদেরকে দেয়া হয়েছে, তা জবাই করার সময় তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে আর সব সময় যেন মনে রাখে একমাত্র আল্লাহই তাদের উপাস্য। অতএব তাঁর কাছেই পুরোপুরি সমর্পিত হও। আর সুসংবাদ দাও সমর্পিত বিনয়াবনতদের, আল্লাহর নাম নেয়া হলেই যাদের অন্তর কেঁপে ওঠে, যারা বিপদে ধৈর্যধারণ করে, নামাজ কায়েম করে আর আমার প্রদত্ত জীবনোপকরণ থেকে দান করে।
— সূরা হজ, আয়াত ৩৪-৩৫
কোরবানির পশুকে আল্লাহ তাঁর মহিমার প্রতীক করেছেন। তোমাদের জন্যে এতে রয়েছে বিপুল কল্যাণ। অতএব এগুলোকে সারিবদ্ধভাবে বাঁধা অবস্থায় এদের জবাই করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করো। এরপর এরা যখন জমিনে লুটিয়ে পড়ে, তখন তা থেকে মাংস সংগ্রহ করে তোমরা খাও এবং কেউ চাক না চাক সবাইকে খাওয়াও। এভাবেই আমি গবাদি পশুগুলোকে তোমাদের প্রয়োজনের অধীন করে দিয়েছি, যাতে তোমরা শুকরিয়া আদায় করো।
— সূরা হজ, আয়াত ৩৬
কিন্তু মনে রেখো কোরবানির মাংস বা রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, আল্লাহর কাছে পৌঁছায় শুধু তোমাদের নিষ্ঠাপূর্ণ আল্লাহ-সচেতনতা। এই লক্ষ্যেই কোরবানির পশুগুলোকে তোমাদের অধীন করে দেয়া হয়েছে। অতএব আল্লাহ তোমাদের সৎপথ প্রদর্শনের মাধ্যমে যে কল্যাণ দিয়েছেন, সেজন্যে তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করো। হে নবী! আপনি সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ দিন যে, আল্লাহ বিশ্বাসীদের রক্ষা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন বিশ্বাসঘাতক, অকৃতজ্ঞকে পছন্দ করেন না।
— সূরা হজ, আয়াত ৩৭-৩৮
ছেলে যখন পিতার কাজকর্মে অংশগ্রহণ করার মতো বড় হলো, তখন ইব্রাহিম একদিন তাকে বলল, ‘হে আমার প্রিয় পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে কোরবানি দিতে হবে। এখন বলো, এ ব্যাপারে তোমার মত কী? ইসমাইল জবাবে বলল, হে আমার পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। ইনশাল্লাহ! আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে বিপদে ধৈর্যশীলদের একজন হিসেবেই পাবেন।
— সূরা সাফফাত, আয়াত ১০২
মনে রেখো, এ ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে সুযোগ দিলাম এক মহান কোরবানির। পুরো বিষয়টি স্মরণীয় করে রাখলাম প্রজন্মের পর প্রজন্মে। ইব্রাহিমের প্রতি সালাম। এভাবেই আমি সৎকর্র্মশীলদের পুরস্কৃত করি।
— সূরা সাফফাত, আয়াত ১০৬-১১০
অতএব তুমি তোমার প্রতিপালকের জন্যেই নামাজ পড় ও কোরবানি দাও। নিশ্চয়ই তোমার প্রতি যেই বিদ্বেষ পোষণ করবে, বিলুপ্ত হবে ওর বংশধারা।
— সূরা কাওসার, আয়াত ২–৩
This article uses material from the Wikipedia বাংলা article কুরবানী, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.