সোয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জা বা সোয়াইন ফ্লু শূকরের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস। ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে পৃথিবীর কয়েকটি দেশে মানব মৃত্যুর কারণ বলে চিহ্নিত হয়েছে। এটি মূলত শূকরের মাঝেই পাওয়া যেত যা কিনা শূকরকে ইনফ্লুয়েঞ্জাতে আক্রান্ত করত। অন্যান্য ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মতই এটি শ্বাসনালিতে সংক্রমন করে থাকে। পূর্বে সোয়াইন ইনফ্লেঞ্জা ভাইরাস মানুষকে আক্রান্ত না করলেও ধারণা করা হচ্ছে, ২০০৯ সালের এপ্রিলে উদ্ভব হওয়া ভাইরাসটি মানুষ, শূকর ও পাখির ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংমিশ্রনে। এটি ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস টাইপ A (H1N1)।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ২০০৯ এর জুন মাসে বিশ্বের ৭৪ টি দেশে নতুন H1N1 ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের উপস্থিতির কারণে এই রোগের সাম্প্রতিক অবস্থাকে বিশ্বব্যাপি মহামারী বলে চিহ্নিত করেছে।। বিশ্বস্বাস্থ সংস্থার মতে সাম্প্রতিক এই সোয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জা মানব ইতিহাসের সবচাইতে আগে হতে এবং বেশি পর্যবেক্ষণ করা মহামারী।
বিভিন্ন প্রানিতে বিভিন্ন ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস পাওয়া যায়। মানুষের জন্য ক্ষতিকর হল ইনফ্লুয়েঞ্জা এ ভাইরাস। সাধারণত একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্টিতে (community) ভাইরাসের যেই ধরনটি (strain) অনেকদিন ধরে বিরাজ করে সেটির বিরুদ্ধে ঐ জনগোষ্টির অধিকাংশ মানুষের দেহে প্রতিরোধ (Immune Defense) ব্যবস্থা গড়ে উঠে বিধায় কোন জনগোষ্টিতে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস পাওয়া গেলও তা মহামারী (Epidemic) ঘটায় না। নতুন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের উদ্ভব হলে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অভাবে নির্দিষ্ট অঞ্চলের জনগোষ্টি ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের আক্রান্ত হয়। নতুন ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের উদ্ভব হতে পারে দুই প্রকারে:
শুকরের মাঝে যেই ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস পাওয়া যায় তাকে সোয়াইন ফ্লু ভাইরাস বলে। এরই ফলশ্রুতিতে এই ধরনের ভাইরাস দ্বারা ঘটিত ফ্লুকেও সোয়াইন ফ্লু বলে। এপ্রিল ২০০৯ সালে যেই ফ্লু মহামারীর আভাস পাওয়া গেছে তাকে সোয়াইন ফ্লু বলা হয়েছে, কারণ শুকর, পাখি ও মানুষের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের জিনের মিশ্রণের ফলেই সেটির উদ্ভব বলে মনে করা হয়৷ ফলে শুকরের মাঝে পাওয়া যাওয়া এই ভাইরাসটি মানুষের মাঝেও সংক্রমন করতে পারছে। যেহেতু মানব গোষ্টিতে এই ভাইরাস আগে ছিল না বিধায় এর বিরুদ্ধের প্রতিরোধের অভাবে কিছু মানুষের মৃত্যু ঘটেছে।
তবে ঋতুকালীন ইনফ্লুয়েঞ্জার (Seasonal Flu) উপসর্গ ও সোয়াইন ফ্লুর উপসর্গ মানুষের মধ্যে প্রায় একই রকম৷ কফ, কাশি, জ্বর, গলাব্যথা, শরীরে ব্যথা, শীতশীত লাগা ও ক্লান্তি- এসবই হলো উপসর্গ (Syndrome)৷ ঋতুকালীন ফ্লু প্রতিবছরই জনসাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়৷ সারা পৃথিবীতে এতে মারা যায় ২.৫-৫ লক্ষ মানুষ৷ আপাতত নতুন ফ্লু ভাইরাস নিয়ে বড় রকমের আতঙ্কের কারণ নেই৷ সারা বিশ্বেই যে এর প্রতিরোধে এখন অনেক বেশি প্রস্তুত৷
১৯১৮ সালে যে ফ্লুর মহামারী হয়েছিল স্পেনে, এতে মারা গিয়েছিল ৫ কোটি মানুষ৷ সেই ভাইরাসটি ছিল ইনফ্লুয়েঞ্জা এ H1N1। ১৯৫৭ সালে এশিয়ান ফ্লুতে মারা যায় দুই মিলিয়ন লোক৷এর মূলে ছিল ইনফ্লুয়েঞ্জা এ H2N2। মানুষ ও বুনোহাঁসের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংমিশ্রনে এই ধরনটির উদ্ভব হয়। ১৯৬৮ সালে হলো যে প্রাদুর্ভাব, হংকংয়ে যা ধরা পড়ল, H3N2 প্রজাতি ছিল এর মূলে৷ এতে মারা গেল পৃথিবীজুড়ে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ। তবে বর্তমানে ফ্লু রোগের বিরুদ্ধে আন্তর্জার্তিক পর্যায়ে বিভিন্ন দেশের ও সংস্থার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস থাকায় মানবজাতির নতুন ফ্লু ভাইরাস হতে আগে চাইতে অনেক অনেক বেশি সচেতন।
মানুষ, শূকর ও পাখির সংমিশ্রনে উদ্ভব হওয়া ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের এই রূপটি সম্পর্কে ধারণা করা হয় এটি শূকরের মাধ্যমে মানুষকে আক্রান্ত করেছে। ইতি পূর্বের এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার সাথে এটির পার্থক্য হচ্ছে এই যে, সোয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জা মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে সক্ষম। এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার ক্ষেত্রে যা দেখা যায় নি।
যেহেতু ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মানব শরীরে ঢুকবার স্থান (Portal of entry) শ্বাসনালি, বিধায় সোয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসও শ্বসনের মাধ্যমে ছড়ায়। শ্বাস নালীর উপরের অংশে (Upper respiratory tract) এটি স্থান নেয়। আক্রান্ত মানুষের হাচি, কাশি প্রভৃতির মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। শুধু তাই নয়, আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত নির্জীব বস্তু যেমন রূমাল, দরজার হাতল, প্রভৃতির মাধ্যমেও এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তি উপসর্গ স্পষ্ট হওয়ার ১ দিন পূর্ব থেকে আক্রান্ত হওয়ার ৭ দিন বা ততোধিক দিন পর্যন্ত অন্যকে আক্রান্ত করতে পারে। তবে খাদ্য বা রক্তের মাধ্যমে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস ছড়ায় না।
সোয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গসমূহ অন্যান্য ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গের মতই। সোয়াইন ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গের মধ্যে জ্বর হওয়া, মাথা ব্যথা, গলা ও শরীর ব্যথা, শ্বাস কষ্ট, ক্ষুদামন্দা ও আলস্যবোধ করা, ওজন কমে যাওয়া ইত্যাদি অন্যতম।
যে সকল মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম বিশেষ করে শিশু ও বয়বৃদ্ধদের জন্য সোয়াইন ফ্লু বেশি বিপদজনক। এছাড়া হাঁপানী এবং হৃদরোগ আক্রান্ত মানুষেরও এ ফ্লু সম্পর্কে বিশেষ সাবধান থাকা উচিত। তাছাড়া যারা এমন রোগে ভুগছেন যাতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায় যেমন, এইডস তাদের বিশেষভাবে সতর্ক থাকা উচিত।
সোয়াইন ফ্লু থেকে নিজেকে দূরে রাখতে শরীর সুস্থ রাখার সব রকম চেষ্টা করতে হবে। সেই সাথে নিজের ফ্লু হলে তা যেন অন্যকে আক্রান্ত না করে সেই ব্যাপারে সচেতন থাকা আবশ্যক। যে সমস্ত কাজ সোয়াইন ফ্লু প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে,
সোয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্য প্রথমেই সন্দেহভাজন ব্যক্তির লালা, নাসিকা রসের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত নমুনা ভাইরার ট্রান্সপোর্ট মিডিয়া (VTM)-এ সংরক্ষণ করে নমুনা পরীক্ষণ গবেষণাগারে (Diagnosis lab) নিয়ে আসা হয়। পরবর্তিতে নমুনা হতে নিউক্লিক অ্যাসিড এক্সট্রাক্সন (Nucleic Acid Extraction) করা হয়। তারপর রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পিসিআরের মাধ্যমে নমুনাতে সোয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের উপস্থিতি নির্ণয় করা যায়। বর্তমানে অত্যাধুনিক রিয়েল টাইম রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পিসিআর (Real Time RT PCR) এর মাধ্যমে খুব দ্রুত ভাইরাসের উপস্থিতি ও সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে।
২০০৯ এর সোয়াইন ফ্লু মহামারী ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের নতুন এনডেমিক (Endemic) নিয়ে শুরু হয়েছে। যদিও সাধারণত একে সোয়াইন ফ্লু নামে ডাকা হয় কিন্তু ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের এ এনডেমিক শূকরে এখন ঘটতে দেখা যায় নি। একে H1N1 ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং 2009 H1N1 flu নামেও ডাকা হয়। এনিমেল হেলথ্ অর্গানিজেসন এর নাম প্রস্তাব করেছিল নর্থ আমেরিকান ইনফ্লুয়েঞ্জা। এপ্রিল ৩০, ২০০৯ এ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ওয়ার্ল্ড হেলথ্ অর্গানিজেসন/WHO) এটিকে ইনফ্লুয়েঞ্জা A (H1N1) নামে ডাকা শুরু করে। মনে করা হয় এ মহামারীটি ২০০৯ এর মার্চ মাস থেকে শুরু হয়েছে। এ যাবৎ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সোয়াইন ফ্লুতে আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। দেশগুলো হল যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, যুক্তরাজ্য, স্পেন, জার্মানি, ইসরাইল, নেদারল্যান্ড, চীন, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া। ২০০৯ এর অগাস্টের ২১ তারিখ নাগাদ সোয়াইন ফ্লুতে আক্রান্তের সংখ্যা ১,৮২,১৬৬। যার মাঝে মৃত্যু ঘটেছে ১৭৯৯ টি ক্ষেত্রে। বিশ্বের প্রায় সবকটি মহাদেশেই (৭৪ টি দেশে) এই ভাইরাসের উপস্থিতি চিহ্নিত করা হয়েছে। সব চাইতে বেশি আক্রান্ত পাওয়া গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে ৫২২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
২০০৯ সালের মার্চে মেক্সিকোতে পাঁচ বছরের শিশু এডগার হার্নানদেজ অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার লক্ষণগুলো ছিল জ্বর, মাথা ব্যাথা এবং গলা ব্যাথা। ডাক্তাররা তার অসুখকে সাধারণ ঠান্ডা জনিত বলে চিহ্নিত করেন। পরবর্তিতে তার স্যাম্পল কানাডাতে পাঠানো হয়। সেখানে বিজ্ঞানীরা এডগারে স্যাম্পলে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস খুজে পান, যেটা মূলত শূকর হতে এসেছিল (সোয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জা)। পরবর্তিতে দেখা যায় ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এডগাড়ের গ্রাম লা গ্লোরিয়াতে কয়েকশত মানুষ একই লক্ষণ জনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছিল।
২০০৯ সালের মার্চে মেক্সিকোর দক্ষিণের রাজ্য ওক্সাকাতে ৩৯ বছর বয়স্কা তিন সন্তানের জননী এডেলা মারিয়া গুটিয়ারেজ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং হাসপাতালে ভর্তি হন। এর ঠিক পাঁচদিন পর গুটিয়ারেজ মৃত্যুবরণ করে। ডাক্তার প্রথমে তার মৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া ধারণা করলেও তার স্যাম্পল কানাডাতে পাঠান এবং সেখানে দেখা যায় গুটিয়ারেজও একই শূকর হতে আসা ইনফ্লুয়েঞ্জা দিয়ে আক্রান্ত হয়েছিল যা কিনা এডগারের মাঝে পাওয়া যায়।
মেক্সিকো সরকারের মতে এডেলা মারিয়া গুটিয়ারেজই সোয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের কারণে মৃত্যর প্রথম ঘটনা।
২০০৯ সালের ১৮ জুন বাংলাদেশে প্রথম সোয়াইন ফ্লু সনাক্তকরা হয়। ১৭ বছর বয়স্ক রোগী যুক্তরাষ্ট্র সফর করে দেশে ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাংলাদেশ সরকারের আইডিসিআর, আসিডিডিআর,বি ও সিডিসির সম্বন্নিত সার্ভাইলেন্স কার্যক্রমে রোগীর দেহে সোয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের উপস্থিতি নির্ণয় করা হয়। তবে রোগী ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেন। বাংলাদেশে এই যাবৎ ১০২ জন ব্যক্তির মাঝে সোয়াইন ফ্লু ভাইরাস পাওয়া গেছে। যদিও কোন মৃত্যুর খবর পাওয়া যাই নি। ভারতে এ যাবৎ ২,৭২২ জন সোয়াইন ফ্লু ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সনাক্ত করা হয়েছে। সোয়াইন ফ্লুতে ভারতে মৃতুর সংখ্যা এ পর্যন্ত ৬০ জন।
3. প্রথম আলো ৩
|month=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)|month=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)|month=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]|month=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)|month=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)|month=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]|month=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)This article uses material from the Wikipedia বাংলা article সোয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জা, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.