সুভাষচন্দ্র বসু

সুভাষচন্দ্র বসু ⓘ (২৩ জানুয়ারি ১৮৯৭ - ?) ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক চিরস্মরণীয় কিংবদন্তি নেতা। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তিনি হলেন এক উজ্জ্বল ও মহান চরিত্র যিনি এই সংগ্রামে নিজের সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেন। তিনি নেতাজি নামে সমধিক পরিচিত। সুভাষচন্দ্র পরপর দুইবার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু গান্ধীর সঙ্গে আদর্শগত সংঘাত, কংগ্রেসের বৈদেশিক ও আভ্যন্তরীণ নীতির প্রকাশ্য সমালোচনা এবং বিরুদ্ধ-মত প্রকাশ করার জন্য তাকে পদত্যাগ করতে হয়।

সুভাষচন্দ্র বসু
সুভাষচন্দ্র বসু
ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান
কাজের মেয়াদ
৪ জুলাই ১৯৪৩ – ১৮ অগাস্ট ১৯৪৫
পূর্বসূরীমোহন সিং
উত্তরসূরীদপ্তরের বিলুপ্তি
সভাপতি
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস
কাজের মেয়াদ
১৮ জানুয়ারি ১৯৩৮ – ২৯ এপ্রিল ১৯৩৯
পূর্বসূরীজওহরলাল নেহরু
উত্তরসূরীরাজেন্দ্র প্রসাদ
কাজের মেয়াদ
২২ জুন ১৯৩৯ – ১৬ জানুয়ারি ১৯৪১
পূর্বসূরীদপ্তর গঠন
৫ম কলকাতার মেয়র
কাজের মেয়াদ
২২ অগাস্ট ১৯৩০ – ১৫ এপ্রিল ১৯৩১
পূর্বসূরীযতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত
উত্তরসূরীবিধানচন্দ্র রায়
ব্যক্তিগত বিবরণ
জন্মসুভাষচন্দ্র বসু
(১৮৯৭-০১-২৩)২৩ জানুয়ারি ১৮৯৭
কটক, ওড়িশা বিভাগ, বেঙ্গল প্রদেশ, ব্রিটিশ ভারত (অধুনা কটক, ওড়িশা রাজ্য, ভারত)
মৃত্যুঅমীমাংসিত এবং বিতর্কিত (তবে, ১৮ অগাস্ট ১৯৪৫, ভারত সরকার কর্তৃক স্বীকৃত)
নাগরিকত্বব্রিটিশ ভারতীয়
জাতীয়তাব্রিটিশ-ভারতীয়
রাজনৈতিক দলফরওয়ার্ড ব্লক
অন্যান্য
রাজনৈতিক দল
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস
মাতাপ্রভাবতী দত্ত
পিতাজানকীনাথ বসু
আত্মীয়স্বজনবসু পরিবার
বাসস্থান৩৮/২ এলগিন রোড, (অধুনা লালা লাজপত রাই সরণি), কলকাতা
শিক্ষা
প্রাক্তন শিক্ষার্থী
যে জন্য পরিচিতভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী
আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগঠক ও সর্বাধিনায়ক
স্বাক্ষরবাংলায় সুভাষচন্দ্র বসুর স্বাক্ষর

সুভাষচন্দ্র মনে করতেন, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর অহিংসা এবং সত্যাগ্রহের নীতি ভারতের স্বাধীনতা লাভের জন্য যথেষ্ট নয়। এই কারণে তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্র ফরওয়ার্ড ব্লক নামক একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন এবং ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতের সত্বর ও পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানাতে থাকেন। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে এগারো বার কারারুদ্ধ করে। তার বিখ্যাত উক্তি "তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো।" দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পরেও তার মতাদর্শের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি; বরং এই যুদ্ধে ব্রিটিশদের দুর্বলতাকে সুবিধা আদায়ের একটি সুযোগ হিসেবে দেখেন। যুদ্ধের সূচনালগ্নে তিনি লুকিয়ে ভারত ত্যাগ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, জার্মানিজাপান ভ্রমণ করেন ভারতে ব্রিটিশদের আক্রমণ করার জন্য সহযোগিতা লাভের উদ্দেশ্যে। জাপানিদের সহযোগিতায় তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ পুনর্গঠন করেন এবং পরে তিনি নেতৃত্ব প্রদান করেন। এই বাহিনীর সৈনিকেরা ছিলেন মূলত ভারতীয় যুদ্ধবন্দি এবং ব্রিটিশ মালয়, সিঙ্গাপুরসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে কর্মরত মজুর। জাপানের আর্থিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তায় তিনি নির্বাসিত আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্বদান করে ব্রিটিশ মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে ইম্ফলব্রহ্মদেশে (বর্তমান মায়ানমার) যুদ্ধ পরিচালনা করেন।

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নাৎসি ও অন্যান্য যুদ্ধবাদী শক্তিগুলির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনের জন্য কোনো কোনো ঐতিহাসিক ও রাজনীতিবিদ সুভাষচন্দ্রের সমালোচনা করেছেন; এমনকি কেউ কেউ তাকে নাৎসি মতাদর্শের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন বলে অভিযুক্ত করেছেন। তবে ভারতে অন্যান্যরা তার ইস্তাহারকে রিয়েলপোলিটিক (নৈতিক বা আদর্শভিত্তিক রাজনীতির বদলে ব্যবহারিক রাজনীতি)-এর নিদর্শন বলে উল্লেখ করে তার পথপ্রদর্শক সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবাদর্শের প্রতি সহানুভূতি পোষণ করেছেন। উল্লেখ্য, কংগ্রেস কমিটি যেখানে ভারতের অধিরাজ্য মর্যাদা বা ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের পক্ষে মত প্রদান করে, সেখানে সুভাষচন্দ্রই প্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে মত দেন। জওহরলাল নেহরুসহ অন্যান্য যুবনেতারা তাকে সমর্থন করেন। শেষ পর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের ঐতিহাসিক লাহোর অধিবেশনে কংগ্রেস পূর্ণ স্বরাজ মতবাদ গ্রহণে বাধ্য হয়। ভগৎ সিংয়ের ফাঁসি ও তার জীবন রক্ষায় কংগ্রেস নেতাদের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ সুভাষচন্দ্র গান্ধী-আরউইন চুক্তি বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। তাকে কারারুদ্ধ করে ভারত থেকে নির্বাসিত করা হয়। নিষেধাজ্ঞা ভেঙে তিনি ভারতে ফিরে এলে আবার তাকে কারারুদ্ধ করা হয়।

জীবনী

১৮৯৭–১৯২১:প্রথম জীবন

সুভাষচন্দ্র বসু 
মানচিত্র ১: ১৭৫৭ থেকে ১৮০৩ সালের মধ্যে ব্রিটিশ বাংলার আয়তন বৃদ্ধি বাদামি রঙে প্রদর্শিত হয়েছে। কলকাতা থেকে কটক প্রায় ২২৫ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত।

সুভাষচন্দ্র বসু ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জানুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত বাংলা প্রদেশের উড়িষ্যা বিভাগের (অধুনা, ভারতের ওড়িশা রাজ্য) কটকে বিখ্যাত কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার মাতা প্রভাবতী বসু (দত্ত) ছিলেন উত্তর কলকাতার হাটখোলা দত্ত বাড়ির কন্যা এবং পিতা জানকীনাথ বসু ছিলেন দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার বিখ্যাত “মাহীনগরের বসু পরিবার" এর সন্তান।

সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন তার পিতা-মাতার চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে নবম তথা ষষ্ঠ পুত্র। তার বাবা জানকীনাথ বসু ছিলেন একজন সফল সরকারি আইনজীবী। তিনি ভাষা ও আইন সম্পর্কিত বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তাদের পৈতৃক নিবাস ছিল ভারতের অধুনা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার কোদালিয়া (বর্তমানে সুভাষগ্রামের অন্তর্ভুক্ত)৷

১৯০২ সালে তিনি তার পাঁচ বড় ভাইয়ের সাথে কটকের প্রোটেস্ট্যান্ট ইউরোপীয় স্কুলে (অধুনা, স্টুয়ার্ট স্কুল) ভর্তি হন। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত তিনি বিদ্যালয়টিতে পঠন-পাঠন করেন। বিদ্যালয়টিতে সমস্ত শিক্ষাদানের মাধ্যম ছিল ইংরেজি, বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ইউরোপীয় বা মিশ্রিত অ্যাংলো-ভারতীয় ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত ছিলেন। পাঠ্যক্রমটিতে ইংরাজী—সঠিকভাবে লিখিত ও কথ্য—লাতিন, বাইবেল, সহবত শিক্ষা, ব্রিটিশ ভূগোল এবং ব্রিটিশ ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত ছিল; কোনও ভারতীয় ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা ছিল না। এই বিদ্যালয় তার পিতা জানকীনাথের পছন্দ ছিল, তিনি চেয়েছিলেন তার ছেলেরা যেন নির্দ্বিধায় ত্রুটিহীন ইংরেজি বলতে পারে। ভারতে ব্রিটিশদের মাঝে থাকার জন্য তিনি বাংলা এবং ইংরেজি উভয় ভাষাকেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। তাঁর বাড়িতে কেবলমাত্র বাংলা ভাষায় কথা বলা হত, ফলে বিদ্যালয়টি ছিল বাড়ির বিপরীত বৈশিষ্ট্যের। বাড়িতে, তার মা হিন্দু দেবী দুর্গাকালীর উপাসনা করতেন, মহাভারতরামায়ণ মহাকাব্য থেকে গল্প বলতেন এবং বাংলা ভক্তিগীতি গাইতেন। মায়ের কাছ থেকে সুভাষ একটি স্নেহশীল স্বভাব লাভ করেন, তিনি দুর্দশাগ্রস্ত লোকদের সাহায্য করতেন ও প্রতিবেশী ছেলেদের সঙ্গে খেলাধুলা করা ও উদ্যানচর্চা পছন্দ করতেন।

সুভাষচন্দ্র বসু 
১৯০৬ সালে শিশু সুভাষচন্দ্র

তার আর পাঁচ ভাইকে অনুসরণ করে সুভাষকে ১৯০৯ সালে ১২ বছর বয়সে কটকের রাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করা হয়। এখানে, বাংলা ও সংস্কৃত শেখানো হত এবং পাশাপাশি বাড়িতে সাধারণত গৃহীত না হওয়া হিন্দু ধর্মগ্রন্থ যেমন— বেদউপনিষদ সম্পর্কে পাঠদান করা হত। যদিও পাশ্চাত্য শিক্ষার তৎপরতা অব্যাহত ছিল তবুও তিনি ভারতীয় পোশাক পরতেন এবং ধর্মীয় ভাবনাচিন্তার সাথে জড়িত ছিলেন। ব্যস্ততা সত্ত্বেও, সুভাষচন্দ্র বসু পড়াশোনায় মনোযোগ , প্রতিযোগিতা ও পরীক্ষায় সফল হওয়ার ক্ষেত্রে দক্ষতা প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি ১৯১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত ম্যাট্রিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন।

সুভাষচন্দ্র বসু আবারও তার পাঁচ ভাইকে অনুসরণ করে ১৯১৩ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। দর্শনকে অধ্যয়ন বিষয় হিসাবে নির্বাচিত করেন ও ক্যান্ট, হেগেল, বের্গসন ও অন্যান্য পাশ্চাত্য দার্শনিকদের সম্পর্কে পড়াশোনা করেন। এর এক বছর আগে হেমন্ত কুমার সরকারের সাথে বন্ধুত্ব করেন, যিনি ছিলেন সুভাষের অত্যন্ত অন্তরঙ্গ ও আধ্যাত্মিক আকুলতার সঙ্গী।

সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেয়ে তিনি প্রায় নিয়োগপত্র পেয়ে যান। কিন্তু বিপ্লব-সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সেই নিয়োগ প্রত্যাখ্যান করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, "কোনো সরকারের সমাপ্তি ঘোষণা করার সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হল তা থেকে (নিজেকে) প্রত্যাহার করে নেওয়া"। এই সময় অমৃতসর হত্যাকাণ্ড ও ১৯১৯ সালের দমনমূলক রাওলাট আইন ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। ভারতে ফিরে সুভাষচন্দ্র 'স্বরাজ' নামক সংবাদপত্রে লেখালেখি শুরু করেন এবং বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির প্রচারের দায়িত্বে নিযুক্ত হন। তার রাজনৈতিক গুরু ছিলেন বাংলায় মহান জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ

সুভাষচন্দ্র ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দু (হিন্দুত্ববাদী নন)। কিন্তু আজাদ হিন্দ ফৌজ পরিচালনা ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রে তিনি সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ ভাবধারায় সকল ধর্মাবলম্বীদের ঐক্যবদ্ধ করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি ধ্যানে অনেক সময় অতিবাহিত করতেন। স্বামী বিবেকানন্দের ভাবাদর্শ তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ছাত্রাবস্থা থেকে তিনি তাঁর দেশপ্রেমিক সত্তার জন্য পরিচিত ছিলেন।

কর্মজীবন ও রাজনীতিতে প্রবেশ

১৯২১ সালের ১৬ জুলাই, ২৪ বছর বয়সী সুভাষচন্দ্র বসু, ইংল্যান্ড থেকে ফিরে ভারতের বোম্বেতে পাড়ি দেন এবং অবিলম্বে গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের আয়োজন করেন। সেসময়, ৫১ বছর বয়স্ক গান্ধী, অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, যা পূর্ববর্তী বছরে ভারতের সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এবং পরবর্তী কয়েক দশকের মধ্যে ভারতকে স্বাধীনতার পথে নিয়ে গিয়েছিল। গান্ধী বোম্বেতে অবস্থান করছিলেন এবং সেদিন বিকেলেই বসুর সাথে দেখা করতে সম্মত হন। অনেক বছর পরে এক লেখায় এই সাক্ষাতের বিবরণে তিনি লেখেন, তিনি গান্ধীকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছিলেন। তাঁর মতে গান্ধীর লক্ষ্য অস্পষ্ট ও তা অর্জনের জন্য তার পরিকল্পনা সুচিন্তিত ছিল না। গান্ধী এবং বসু প্রথম সাক্ষাতেই আন্দোলনের উপায় সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করেন। গান্ধী অহিংস আন্দোলন সম্পর্কে ছিলেন আপোষহীন। তবে বসুর মতে, ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে যেকোনো উপায়ই গ্রহণযোগ্য ছিল। তারা পরিণতির প্রশ্নে ভিন্নমত পোষণ করেন। সুভাষচন্দ্র বসু একনায়কতান্ত্রিক শাসনের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন কিন্তু গান্ধী পরিপূর্ণভাবে এর বিপরীত অবস্থান নেন। ঐতিহাসিক গর্ডনের মতে, 'গান্ধী অবশ্য বসুকে বাংলায় কংগ্রেস ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদের নেতা সি আর দাশের পথে পরিচালিত করেন এবং তার মধ্যে বসু তার কাঙ্ক্ষিত নেতা খুঁজে পান।' চিত্তরঞ্জন দাশ গান্ধীর চেয়ে বেশি নমনীয় ও চরমপন্থার প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল ছিলেন, যা সেসময় বাংলায় বসুর মতো আদর্শবাদী তরুণদের আকৃষ্ট করেছিল। চিত্তরঞ্জন, সুভাষচন্দ্র -কে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে প্রবেশ করান। সুভাষচন্দ্র পরবর্তী প্রায় ২০ বছর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন।

সুভাষচন্দ্র বসু 
১৯২৬ সালে প্রাগে ইন্ডিয়া সোসাইটির অনুষ্ঠানে সুভাষচন্দ্র বসু।

তিনি স্বরাজ পত্রিকা চালু করেন এবং বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির প্রচারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯২৩ সালে সুভাষচন্দ্র সর্বভারতীয় যুব কংগ্রেসের সভাপতি এবং একইসাথে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসে র সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি চিত্তরঞ্জন দাস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ফরওয়ার্ড পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও কর্মরত ছিলেন। ১৯২৪ সালে চিত্তরঞ্জন দাস কলকাতার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর বসু কলকাতা পৌরসংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। ১৯২৫ সালে সুভাষচন্দ্র বসুকে গ্রেফতার করে মান্দালয়ের কারাগারে পাঠানো হয়, যেখানে তিনি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন।

১৯২৭ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সুভাষ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক হন এবং জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে বসু কলকাতায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক সভার আয়োজন করেন। তার সবচেয়ে স্মরণীয় ভূমিকা ছিল কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) হিসেবে। এর কিছুদিন পরে, সুভাষচন্দ্র বসুকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয় এবং আইন অমান্য আন্দোলনের জন্য জেলে পাঠানো হয়। এরপর ১৯৩০ সালে তিনি কলকাতার মেয়র নির্বাচিত হন।

সুভাষচন্দ্র বসু 
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক সভায় কংগ্রেস সভাপতি মতিলাল নেহেরুর সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসু (সামরিক পোশাকে)।

১৯৩০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে সুভাষচন্দ্র বসু ইউরোপ ভ্রমণ করেন। এসময় বিভিন্ন ভারতীয় ছাত্র ও বেনিতো মুসোলিনি সহ অন্যান্য ইউরোপীয় রাজনীতিবিদদের সাথে দেখা করেন তিনি। তিনি দলীয় সংগঠন এবং কমিউনিজমফ্যাসিবাদের প্রয়োগ পর্যবেক্ষণ করেন। এই সময়ে তিনি তার, দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল বইয়ের প্রথম অংশ রচনা করেন, যাতে ১৯২০-১৯৩৪ সালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিবরণ রয়েছে। যদিও এটি ১৯৩৫ সালে লন্ডনে প্রকাশিত হয়, কিন্তু ব্রিটিশ সরকার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ভয়ে ভারতে এই বই নিষিদ্ধ করে।

১৯৩৪ সালে লবণ সত্যাগ্রহ বন্ধ করলে তিনি ও বীঠলভাই প্যাটেল ইউরোপ থেকে সুভাষচন্দ্র -প্যাটেল ইস্তাহার দেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] বীঠলভাই প্যাটেল তার সম্পত্তির চার ভাগের তিন ভাগ নেতাজিকে দান করেন,পরবর্তীতে তাঁর ছোটো ভাই বল্লভভাই প্যাটেল তা অস্বীকার করেন এবং তাঁকে জালিয়াত সহ নানা খারাপ আখ্যা দেন। কুড়ি বছরের মধ্যে সুভাষচন্দ্র মোট ১১ বার গ্রেফতার হয়েছিলেন। তাঁকে ভারত ও রেঙ্গুনের বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছিল। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে তাকে ইউরোপে নির্বাসিত করা হয়। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে ভিয়েনাতে তিনি তার প্রথম প্রেম এমিলি শেঙ্কলের সঙ্গে পরিচিত হন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁরা ব্যাড গ্যাস্টিনে বিয়ে করেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

সুভাষচন্দ্র বসু 
অস্ট্রিয়ার ব্যাড গ্যাস্টিনে এমিলি শেঙ্কলের সাথে সুভাষচন্দ্র বসু।

১৯৩৮ সালে সুভাষচন্দ্র বসু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সম্পর্কে তাঁর অভিমত সম্বন্ধে বলেন যে, 'রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ এবং একটি সমাজতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার দ্বিমাত্রিক উদ্দেশ্য নিয়ে বৃহত্তর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ফ্রন্টে সংগঠিত হওয়া উচিত।' ১৯৩৮ সাল অবধি সুভাষচন্দ্র জাতীয় পর্যায়ের নেতায় পরিণত হয়েছিলেন এবং কংগ্রেস দলের সভাপতি হিসেবে মনোনয়ন গ্রহণ করতে সম্মত হন। তিনি ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগসহ শর্তহীন স্বরাজের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। এর ফলে তাঁর সাথে মোহনদাস গান্ধীর সংঘাত সৃষ্টি হয়, যিনি প্রকৃতপক্ষে বসুর সভাপতি পদের বিরোধিতা করেন। ফলশ্রুতিতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলটি বিভক্ত হয়ে যায়।

বসু ঐক্য বজায় রাখার চেষ্টা করেন, কিন্তু গান্ধী সুভাষকে তাঁর নিজস্ব পরিষদ গঠন করার পরামর্শ দেন। এই ঘটনায় বসু ও নেহেরুর মধ্যেও বিভাজন তৈরী হয়। সুভাষচন্দ্র একটি স্ট্রেচারে করে ১৯৩৯ সালের কংগ্রেস সভায় হাজির হন। তিনি গান্ধীর পছন্দের প্রার্থী পট্টভি সীতারামাইয়াকে পরাজিত করে পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হন। মুথুরামালিঙ্গম থেভার আন্তঃকংগ্রেস বিতর্কে বসুকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন। তার জন্য দক্ষিণ ভারতের সকল ভোট বসুর পক্ষে যায়। যাহোক, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে গান্ধী নেতৃত্বাধীন দলের বিভিন্ন কৌশলের কারণে, সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

সুভাষচন্দ্র বসু 
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে সর্ব ভারতীয় কংগ্রেস কমিটির সভায় সুভাষচন্দ্র বসু

১৯৩৯ সালের ২২ জুন বসু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে নিখিল ভারত ফরওয়ার্ড ব্লক সংগঠিত করেন মূলত বামপন্থী রাজনৈতিকদের মজবুত করার লক্ষ্যে কিন্তু এর প্রধান শক্তি ছিল তার নিজের রাজ্য বাংলায়। শুরু থেকে সুভাষচন্দ্রের একনিষ্ঠ সমর্থক, মুথুরামালিঙ্গম থেভার ফরওয়ার্ড ব্লকে যোগ দেন। একই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর বসু যখন মাদুরাই গিয়েছিলেন তখন তার অভ্যর্থনার উদ্দেশ্যে মুথুরামালিঙ্গম একটি বিশাল র‍্যালির আয়োজন করেন।

মাদুরাই যাওয়ার পথে সুভাষচন্দ্র বসু, মুথুরামালিঙ্গমের আমন্ত্রণে ফরওয়ার্ড ব্লকের পক্ষে সমর্থন সংগ্রহে, মাদ্রাজ ভ্রমণ করেন এবং সেখানে তিন দিন অতিবাহিত করেন। তার চিঠিপত্র প্রকাশ করে যে, ব্রিটিশ পরাধীনতার প্রতি তার স্পষ্ট অপছন্দ সত্ত্বেও, তিনি তাদের পদ্ধতিগত ও নিয়মানুগ দৃষ্টিভঙ্গি এবং জীবনের প্রতি তাঁদের দৃঢ় শৃঙ্খলামূলক মনোভাব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ইংল্যান্ডে তিনি ব্রিটিশ লেবার পার্টির বিভিন্ন নেতা ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ যেমন লর্ড আরউইন, জর্জ ল্যান্সবারি, ক্লিমেন্ট এটলি, আর্থার গ্রীনউড, হ্যারল্ড লাস্কি, জে বি এস হ্যালডেন, আইভর জেনিংস, গিলবার্ট মারে, জর্জ ডগলাস হাওয়ার্ড কোল, স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস‌ প্রমুখের সঙ্গে ভারতের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মত বিনিময় করেন।

তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, স্বাধীন ভারতের অন্তত দুই দশক পর্যন্ত তুরস্কের কামাল আতাতুর্কের অনুরূপ সমাজতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র প্রয়োজন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] আঙ্কারায় আতাতুর্কের সাথে তাঁর দেখা করার অনুমতি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিক কারণে প্রত্যাখ্যান করে। ইংল্যান্ডে তাঁর সফরের সময় সুভাষচন্দ্র বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদের সাথে সাক্ষাতের চেষ্টা করেন, কিন্তু শুধুমাত্র লেবার পার্টি এবং উদারনৈতিক রাজনীতিবিদরা তার সাথে সাক্ষাৎ করতে সম্মত হন। কনজারভেটিভ পার্টির কর্মকর্তারা তাঁর সাথে দেখা করতে অপারগতা প্রকাশ করেন অথবা তিনি উপনিবেশ থেকে আসা একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন বলে তাঁকে সৌজন্য দেখাতে তারা অস্বীকার করেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল, লর্ড লিনলিথগো কংগ্রেস নেতৃত্বের সাথে আলোচনা না করেই ভারতের পক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। সুভাষচন্দ্র বসু এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করার জন্য গণ আইন অমান্য আন্দোলন আয়োজনের পক্ষে প্রচারণা শুরু করেন। কিন্তু গান্ধীকে এর অপরিহার্যতা বোঝাতে ব্যর্থ হলে, তিনি কলকাতার অন্ধকূপ হত্যা ঘটনার স্মরণে, ডালহৌসি স্কোয়ারের এক কোণে নির্মিত 'হলওয়েল মনুমেন্ট' অপসারণের দাবিতে গণ বিক্ষোভের আয়োজন করেন। এসময় তাঁকে গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করা হলেও সাত দিনের অনশন ধর্মঘটের পর ১৯৪০ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।

১৯৪১–১৯৪৩: নাৎসি জার্মানি

১৯৪১ সালে সুভাষচন্দ্র বসুকে গৃহবন্দী করা হয়। এসময় সিআইডি তার বাড়ি নজরদারিতে রাখে। তবুও তিনি আফগানিস্তান এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে জার্মানিতে পালাতে সক্ষম হন। পালানোর কয়েকদিন আগে, তিনি নিঃসঙ্গ থাকার অজুহাতে ব্রিটিশ রক্ষীদের সাথে দেখা করা এড়িয়ে চলেন এবং লম্বা দাড়ি রাখেন। ১৯৪১ সালের ১৬ জানুয়ারি, গভীর রাতে পালানোর সময়, তিনি পাঠানদের বেশভূষা ধারণ করেন যাতে কেউ তাকে চিনতে না পারে। ১৯৪১ সালের ১৭ জানুয়ারি রাতে কলকাতায় তার এলগিন রোডের বাড়ি থেকে ব্রিটিশদের নজরদারি এড়িয়ে, তার ভাগ্নে শিশির কুমার বসুকে সঙ্গে নিয়ে সুভাষচন্দ্র বসু পালাতে সক্ষম হন। তারা পালিয়ে তৎকালীন বিহার রাজ্যের (বর্তমানে ঝাড়খণ্ড) গোমোহ্‌ রেলওয়ে স্টেশনে (বর্তমানে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু গোমোহ্‌ স্টেশন) পৌছান।

তিনি তৎকালীন জার্মান সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আবওয়ের সাহায্যে পেশোয়ার পৌঁছান। সেখানে তিনি আকবর শাহ, মোহাম্মদ শাহ এবং ভগত রাম তলওয়ারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাকে আকবর শাহের বিশ্বস্ত বন্ধু আবাদ খানের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৪১ সালের ২৬ জানুয়ারি তিনি আফগানিস্তান সংলগ্ন ব্রিটিশ ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ দিয়ে রাশিয়া পৌছানোর জন্য যাত্রা শুরু করেন। এর জন্য তিনি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের তৎকালীন ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা মিঞা আকবর শাহ এর সাহায্য গ্রহণ করেন। শাহ তাকে একটি অভিনব ছদ্মবেশ ধারণের প্রস্তাব দেন। যেহেতু বসু পশতু ভাষার একটি শব্দও জানতেন না, ব্রিটিশদের জন্য কর্মরত পশতু বক্তাদের পক্ষে তাকে সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব ছিল। এজন্য শাহ তাকে বধির এবং বোবা হওয়ার অভিনয় করার পরামর্শ দেন এবং সেখানকার উপজাতিদের অনুকরণে তার দাড়ি বৃদ্ধি করতে বলেন। তার পথপ্রদর্শক ভগত রাম তলওয়ার একজন সোভিয়েত গোয়েন্দা ছিল, যদিও সুভাষচন্দ্র বসু সে সম্পর্কে অবগত ছিলেন না।

সুভাষচন্দ্র বসু 
১৯৪১ সালে তার বাড়ি থেকে পালানোর সময় সুভাষচন্দ্র বসু যে ঐতিহাসিক ওয়ান্ডারার গাড়িটি ব্যবহার করেন।

সুলতান মুহাম্মদ শাহ আগা খান এর সমর্থকরা তাকে সীমান্ত পেরিয়ে আফগানিস্তানে যেতে সাহায্য করে, যেখানে আবওয়ের এর একটি ইউনিট তার সাথে দেখা করে ও কাবুল হয়ে আফগানিস্তান পেরিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার সীমান্তে পৌঁছাতে তাকে সাহায্য করে। একজন পশতুন বীমা এজেন্ট ("জিয়াউদ্দিন") সেজে আফগানিস্তানে পৌছানোর পর, তিনি তার ছদ্মবেশ পরিবর্তন করেন এবং একজন ইতালীয় অভিজাত ব্যক্তি, "কাউন্ট অরল্যান্ডো মাজোত্তা" সেজে ইতালীয় পাসপোর্টে মস্কো পৌঁছান। মস্কো থেকে তিনি রোমে পৌছান, এবং সেখান থেকে জার্মানিতে পাড়ি দেন। রাশিয়ায় পৌছানোর পর, সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা, এনকেভিডি, তাকে মস্কোতে নিয়ে যায়। তিনি আশা করেছিলেন যে, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি রাশিয়ার ঐতিহ্যগত শত্রুতার ফলস্বরূপ তারা তার ভারতে জন উত্থান ঘটানোর পরিকল্পনাকে সমর্থন করবে। তবে, সোভিয়েতদের প্রতিক্রিয়া দেখে তাঁকে হতাশ হতে হয়। তাঁকে দ্রুত মস্কোতে উপস্থিত জার্মান রাষ্ট্রদূত কাউন্ট ফন ডার শুলেনবার্গের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তিনি এপ্রিলের শুরুতে, একটি বিশেষ কুরিয়ার বিমানে করে সুভাষচন্দ্র বসুর বার্লিনে পৌছানোর ব্যবস্থা করেন। .

সুভাষচন্দ্র বসু 
জার্মানির পূর্ব প্রুসিয়াতে হিটলারের সাথে সুভাষচন্দ্র। বামে দোভাষী পল স্মিত। মে- জুন ১৯৪২

জার্মানিতে পৌঁছানোর পর, তিনি জার্মান পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত আজাদ হিন্দ রেডিওর সম্প্রচারের দায়িত্বে থাকা ভারতের স্পেশাল ব্যুরোর সাথে যুক্ত হন। তিনি বার্লিনে ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন এবং ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের মধ্য থেকে সৈন্য নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী গঠন করেন। অক্ষশক্তির হাতে বন্দী হওয়ার আগে এই সৈন্যরা উত্তর আফ্রিকায় ব্রিটিশদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল। ভারতীয় বাহিনী শুরুতে ভেরমাখট (নাৎসি জার্মানির ঐক্যবদ্ধ সামরিক বাহিনী) এর সাথে সংযুক্ত ছিল। পরে তা ওয়াফেন এসএস বাহিনীর সাথে সংযুক্ত করা হয়। এর সদস্যরা হিটলার এবং সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করে: "আমি ঈশ্বরের শপথ করে বলছি যে সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে, ভারতের জন্য যুদ্ধে আমি জার্মান জাতি ও রাষ্ট্রের নেতা আডলফ হিটলার কে জার্মান সামরিক বাহিনীর সেনাপতি হিসেবে মেনে চলব"। তিনি আজাদ হিন্দ বাহিনীর নেতৃত্বে নাৎসি সৈন্যদের দ্বারা সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে ভারত আক্রমণের পরিকল্পনা করতেও প্রস্তুত ছিলেন; অনেকেই তার এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, কারণ এই ধরনের আগ্রাসনের পর জার্মানদের সহজে ভারত ছেড়ে যেতে রাজি করানো যেত না, যার ফলে যুদ্ধে অক্ষশক্তির বিজয়ও ঘটতে পারতো।

সব মিলিয়ে ৩০০০ ভারতীয় যুদ্ধবন্দী আজাদ হিন্দ বাহিনীতে যোগদান করেন। তবে খুশি হওয়ার বদলে, সুভাষচন্দ্র বসু বেশ চিন্তিত ছিলেন। বামপন্থী রাশিয়ার একজন ভক্ত হিসেবে, হিটলারের ট্যাংক এর সোভিয়েত সীমান্ত অতিক্রম দেখে তিনি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় যখন নাৎসি বাহিনীর পশ্চাদপসরণ শুরু হয়। কেননা এতে ভারত থেকে ব্রিটিশদের বিতাড়িত করতে সাহায্য প্রদান করার মত কোন অবস্থান জার্মান বাহিনীর থাকবে না। ১৯৪২ সালের মে মাসে হিটলারের সাথে তার সাক্ষাৎ এরপর, তার সন্দেহ আরও দৃঢ় হয় এবং তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে হিটলার তার সৈন্যদের ব্যবহার করে যুদ্ধক্ষেত্রের চেয়ে প্রচারণার জয়ী হতেই বেশি আগ্রহী। তাই, ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি একটি জার্মান ইউ-বোটে করে জাপান চলে যান। এর ফলে জার্মানিতে তার সৈন্যরা নেতৃত্বহীন এবং হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত বার্লিনে বসবাস করেন। ১৯৩৪ সালে জার্মানিতে তার প্রথম সফরের সময়, তার সাথে একজন অস্ট্রীয় পশু চিকিৎসকের কন্যা, এমিলি শেঙ্কল এর পরিচয় হয়। তিনি এমিলিকে ১৯৩৭ সালে বিয়ে করেন। তাদের কন্যার নাম অনিতা বসু পাফ। বসুর দল ফরওয়ার্ড ব্লক এই তথ্য অস্বীকার করেছে।

সুভাষচন্দ্র বসু 
অস্ট্রিয়ায় দুই মাসের ছুটি শেষে ১৯৩৮ সালের ২৪ জানুয়ারি কলকাতায় ফিরছেন।

১৯৪৩–১৯৪৫: জাপান অধিকৃত এশিয়া

১৯৪৩ সালে, জার্মানি ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে সাহায্য করতে পারবে না বুঝতে পেরে, সুভাষচন্দ্র বসু জাপান চলে যান। তিনি জার্মান ডুবোজাহাজ, ইউ-১৮০ তে করে মাদাগাস্কারের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে পৌঁছান, যেখানে তাকে বাকি পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য জাপানি ডুবোজাহাজ, আই-২৯ এ স্থানান্তর করা হয়। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দুটি ভিন্ন নৌবাহিনীর দুটি ডুবোজাহাজের মধ্যে ঘটা একমাত্র বেসামরিক ব্যক্তির হস্তান্তর।

সুভাষচন্দ্র বসু 
জাপানি ডুবোজাহাজ আই-২৯ এ সামনের সারিতে (বাম থেকে দ্বিতীয়) বসা সুভাষচন্দ্র বসু (২৮ এপ্রিল ১৯৪৩)।

জাপানি গোয়েন্দা বিভাগ, ফুজিওয়ারা কিকান এর প্রধান, মেজর (এবং যুদ্ধোত্তর লেফটেন্যান্ট-জেনারেল) ইওয়াইচি ফুজিওয়ারা সর্বপ্রথম আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনের কথা ভাবেন। ফুজিওয়ারার লক্ষ্য ছিল "একটি সেনা বাহিনী গঠন করা যা জাপানি সেনাবাহিনীর পাশাপাশি যুদ্ধ করবে।" তিনি সর্বপ্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের ব্যাংকক অধ্যায়ের সভাপতি প্রীতম সিং ধিলনের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং প্রীতম সিং এর যোগাযোগের মাধ্যমে ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে পশ্চিম মালয় উপদ্বীপে বন্দী ব্রিটিশ ভারতীয় সেনা অধিনায়ক মোহন সিং কে নিয়োগ দেন। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধে ফুজিওয়ারা ও মোহন সিং এর মধ্যে আলোচনার ফলে প্রথম আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠিত হয়। ১৯৪২ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তারা যৌথভাবে এর নাম মনোনীত করেন।

প্রবাসী জাতীয়তাবাদী নেতা রাসবিহারী বসুর নেতৃত্বে পরিচালিত তৎকালীন ভারতীয় স্বাধীনতা লীগ এর সমর্থনেই এগুলো হয়। ১৯৪২ সালের ডিসেম্বরে হিকারি কিকান এবং মোহন সিং মধ্যে মতানৈক্য ঘটার পর প্রথম আজাদ হিন্দ ফৌজ ভেঙ্গে দেওয়া হয়। মোহন বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে, জাপানি হাইকমান্ড নিছক প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে আজাদ হিন্দ ফৌজকে ব্যবহার করছে। এসময় মোহন সিং কে আটক করা হয় এবং সৈন্যদের বন্দী শিবিরে ফেরত নেওয়া হয়। যাইহোক, ১৯৪৩ সালে সুভাষচন্দ্র বসুর আগমনের সঙ্গে স্বাধীনতার জন্য সেনাবাহিনী গঠনের ধারণাটি আবারো পুনরুজ্জীবিত হয়। জুলাই মাসে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত একটি সভায় রাসবিহারী বসু, সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করেন। সুভাষচন্দ্র বসু সেনাবাহিনী পুনর্গঠন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবাসী ভারতীয় জনগণের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন সংগঠিত করতে সক্ষম হন। প্রবাসী ভারতীয়রা একইসাথে জাতীয় সেনাবাহিনীতে তালিকাভুক্ত হয়ে এবং স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আর্থিকভাবে সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেন। আজাদ হিন্দ ফৌজ এ একটি পৃথক নারী ইউনিট ছিল যার নাম ঝাঁসি রানী রেজিমেন্ট (রানী লক্ষ্মীবাঈ এর নামে নামকরণ হয়)। ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগল এর নেতৃত্বে এই বাহিনী গঠিত হয়। এটিকে এশিয়ায় এধরণের প্রথম দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

সামরিক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েও সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন বজায় রাখতে সক্ষম হন। ১৯৪৪ সালের ৪ জুলাই, বর্মায় ভারতীয়দের এক সমাবেশে আজাদ হিন্দ ফৌজ এর জন্য একটি ভাষণ প্রদানের সময় তার সবচেয়ে বিখ্যাত উক্তিটি উচ্চারিত হয়: "তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো!" এর মাধ্যমে তিনি ভারতের জনগণকে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। আজাদ হিন্দ ফৌজ এর সৈন্যরা, অস্থায়ী সরকার আর্জি হুকুমত-এ-আজাদ হিন্দ এর অধীনে ছিল। এই সরকার নিজস্ব মুদ্রা, ডাকটিকিট, আদালত এবং সিভিল কোড উপস্থাপন করে এবং অক্ষশক্তির নয়টি তৎকালীন রাষ্ট্র – জার্মানি, জাপান, ইতালীয় সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, জার্মানি নিয়ন্ত্রিত ক্রোয়েশিয়া, চীন, বর্মা, মাঞ্চুকুও, জাপান নিয়ন্ত্রিত ফিলিপাইন একে স্বীকৃতি দেয়। এই রষ্ট্রগুলোর মধ্যে পাঁচটিই অক্ষশক্তির অধীনে প্রতিষ্ঠিত। এই সরকার ১৯৪৩ সালের নভেম্বর মাসে পর্যবেক্ষক হিসেবে তথাকথিত বৃহত্তর পূর্ব এশিয়া সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে।

সুভাষচন্দ্র বসু 
১৯৪৩ সালে টোকিও তে অনুষ্ঠিত বৃহত্তর পূর্ব এশিয়া সম্মেলনে সুভাষচন্দ্র বসু (সামনের সারিতে সর্বডানে)।

আজাদ হিন্দ ফৌজ এর প্রথম দায়িত্ব ছিল পূর্ব ভারতীয় সীমান্তের মণিপুরের দিকে জাপানি আগ্রাসনে সহায়তা করা। জাপানিরা আরাকানে হামলার সময় এবং একই সাথে ইম্ফলকোহিমার দিকে আগ্রাসনের সময় আজাদ হিন্দ ফৌজ এর বিশেষ বাহিনী বাহাদুর গ্রুপ শত্রু রেখার পিছনে বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেয়। জাপানিরা ১৯৪২ সালে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নেয় এবং এর এক বছর পর সেখানে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ ডি লোগনাথন কে গভর্নর জেনারেল করে অস্থায়ী সরকার ও আজাদ হিন্দ ফৌজ প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বীপগুলির নাম পরিবর্তন করেশহীদস্বরাজ রাখা হয়। যদিও, দ্বীপ প্রশাসনের মূল নিয়ন্ত্রণ জাপানি নৌবাহিনীর হাতেই ছিল। ১৯৪৪ সালের প্রথম দিকে দ্বীপে সুভাষচন্দ্র বসুর একমাত্র ভ্রমণের সময়, বোসের জাপানি নিমন্ত্রণকর্তারা সচেতনভাবেই তাকে স্থানীয় জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে যাতে জাপানিদের চূড়ান্ত স্বার্থ সম্পর্কে তিনি কোনো ধরনের জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম না হন। সে সময় দ্বীপের জাপানি প্রশাসন ওই দ্বীপের ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের নেতা ডা. দিওয়ান সিং কে আটক রেখে নির্যাতন করছিল, যিনি পরে জেলে আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। দ্বীপে সুভাষচন্দ্র বসুর পরিদর্শন কালে বেশ কয়েকজন স্থানীয় ব্যক্তি ডা. সিং এর দুর্দশা সম্পর্কে তাকে জানানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এসময় লেফটেন্যান্ট কর্নেল লোগনাথন তার প্রকৃত প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের অভাব সম্পর্কে সচেতন হন এবং গভর্নর জেনারেলের পদ থেকে পদত্যাগ করে রেঙ্গুনে আজাদ হিন্দ সরকারের সদর দপ্তরে ফিরে আসেন।

ভারতের মূল ভূখণ্ডে, উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুরের মৈরাং শহরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অনুকরণে তৈরীকৃত একটি ত্রিবর্ণ পতাকা প্রথমবারের মত উত্থাপিত হয়। এরপর ইম্ফল ও কোহিমার পার্শ্ববর্তী শহরগুলো জাপানি সেনাবাহিনীর কিছু বিভাগ, আজাদ হিন্দ ফৌজ এর গান্ধী ও নেহরু ব্রিগেড এর সহায়তায় ঘেরাও ও অবরোধ করা শুরু করে। অক্ষশক্তি ভারতের মূল ভূখণ্ড জয় করার এই প্রচেষ্টাকে অপারেশন ইউ-গো আখ্যায়িত করে।

সুভাষচন্দ্র বসু 
১৯৪৩ সালে টোকিওতে বক্তৃতা দানরত সুভাষচন্দ্র বসু।

এই অপারেশনের সময়, ১৯৪৪ সালের ৬ জুলাই, সিঙ্গাপুর থেকে আজাদ হিন্দ রেডিও কর্তৃক সম্প্রচারিত একটি বক্তৃতায়, সুভাষচন্দ্র বসু মহাত্মা গান্ধীকে "জাতির পিতা" বলে সম্বোধন করেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য তার আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছা কামনা করেন। এই প্রথম গান্ধীকে এমন সম্বোধন করা হয়। এই দুই শহর দখল করার দীর্ঘ প্রচেষ্টায় জাপানি সম্পদ ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে ও পরিশেষে অপারেশন ইউ-গো ব্যর্থ প্রমাণিত হয়। কয়েক মাস ধরে এই দুই শহরে জাপানিদের আক্রমণের সময় কমনওয়েলথ বাহিনী শহরের ভেতরে আটকে ছিল। কমনওয়েলথ বাহিনী তারপর পাল্টা আক্রমণ করে ও অক্ষশক্তির গুরুতর ক্ষতিসাধন করে। ফলে জাপানিরা বার্মিজ এলাকায় পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। কোহিমা ও ইম্ফলের যুদ্ধে জাপানিদের পরাজয়ের পর, ভারতের মূল ভূখণ্ডে আজাদ হিন্দ সরকারের একটি ঘাঁটি স্থাপনের লক্ষ্য চিরকালের জন্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

তবুও আজাদ হিন্দ ফৌজ বর্মায় ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মেইকটিলা, মান্দালয়, বাগো, মাউন্ট পোপা ইত্যাদি অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যাইহোক, রেঙ্গুনের পতনের সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসুর সরকার একটি কার্যকর রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] এরপর লেফটেন্যান্ট কর্নেল লোগনাথনের অধীনে আজাদ হিন্দ ফৌজ এর একটি বড়ো অংশ আত্মসমর্পণ করে। অবশিষ্ট সৈন্যরা সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে মালয়ে পশ্চাদপসরণ করে অথবা থাইল্যান্ডের দিকে যাত্রা করে। যুদ্ধ শেষে জাপানের আত্মসমর্পণ আজাদ হিন্দ ফৌজ এর সমাপ্তি ঘটায়। এরপর বন্দীদের ভারতে ফেরত পাঠানো হয় এবং কিছু সৈন্যকে বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে দণ্ডিত করা হয়।

ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী

ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি) মূলত গড়ে উঠেছিল জাতীয়তাবাদী নেতা রাসবিহারী বসুর হাতে, ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে রাসবিহারী বসু এই সেনাবাহিনীর দায়িত্ব সুভাষচন্দ্র বসুকে হস্তান্তর করেণ । একটি আলাদা নারী বাহিনী (রানি লক্ষ্মীবাঈ কমব্যাট) সহ এতে প্রায় ৮৫,০০০ (পঁচাশি হাজার) সৈন্য ছিল। এই বাহিনীর কর্তৃত্ব ছিল প্রাদেশিক সরকারের হাতে, যার নাম দেওয়া হয় "মুক্ত ভারতের প্রাদেশিক সরকার" (আর্জি হুকুমত-এ-আজাদ হিন্দ)। এই সরকারের নিজস্ব মুদ্রা, আদালত ও আইন ছিল। অক্ষ শক্তির ৯টি দেশ এই সরকারকে স্বীকৃতি দান করে। আইএনএ-র সৈন্যরা জাপানিদের আরাকান ও মেইক্টিলার যুদ্ধে সাহায্য করে।

সুভাষচন্দ্র বসু আশা করেছিলেন, ব্রিটিশদের উপর আইএনএ-র হামলার খবর শুনে বিপুল সংখ্যক সৈন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে হতাশ হয়ে আইএনএ-তে যোগ দেবে। কিন্তু এই ব্যাপারটি তেমন ব্যাপকভাবে ঘটলনা। বিপরীতদিকে, যুদ্ধ পরিস্থিতির অবনতির সঙ্গে সঙ্গে জাপান তার সৈন্যদের আইএনএ থেকে সরিয়ে নিতে থাকে। একই সময় জাপান থেকে অর্থের সরবরাহ কমে যায়। অবশেষে, জাপানের আত্মসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গে আইএনএ আত্মসমর্পণ করে।

১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে বর্মার (বর্তমান মায়ানমার) মান্দালয়ের জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় সুভাষচন্দ্র গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ব্রিটিশ সরকার তাকে এক শর্তে মুক্তি দিতে রাজি হন যে, ভারতের কোনো ভূখণ্ড না-ছুঁয়ে তিনি যদি বিদেশে কোথাও পাড়ি দেন তবে মুক্তি পাওয়া যাবে। সুভাষচন্দ্র ইউরোপে যাওয়া মনস্থ করেন ও ভিয়েনা পৌঁছান। দু-বছর চিকিৎসাধীন থাকার সময়ে অবসরে তিনি দুটি বই লেখার সিদ্ধান্ত নেন, তার আত্মজীবনী 'Indian Pilgrim' আর 'India's Struggle for Freedom'। সেই সময়ে তার পাণ্ডুলিপি টাইপ করার জন্যে এক অস্ট্রিয়ান মহিলা এমিলি শেংকেল তাকে সাহায্য করেন যিনি পরবর্তীকালে তার সচিবও হন। এমিলি শেংকেল কখনো ভারতে আসেননি, কিন্তু বৃহত্তর বসু পরিবার ও নেতাজির সহযোগীদের সঙ্গে তার চিরকাল যোগাযোগ ও সুসম্পর্ক ছিল। ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রয়াত হন।

মৃত্যু

সুভাষচন্দ্র বসু 
সুভাষচন্দ্র বসুর শেষ বিমান যাত্রা: নীল (সম্পন্ন), লাল (সম্পন্ন হয়নি)।

ঐতিহাসিকদের মতে, ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট, সুভাষচন্দ্র বসুকে বহনকারী জাপানি বিমান, জাপান শাসিত ফোরমোসায় (বর্তমান তাইওয়ান) বিধ্বস্ত হওয়ার পর, আগুনে দগ্ধ হয়ে বসুর মৃত্যু ঘটে। তবে, তার অনেক অনুগামীই, বিশেষত বাংলায়, সে সময় ঘটনাটি অস্বীকার করে এবং এমনকি এখনো তার মৃত্যু সম্পর্কিত পরিস্থিতি ও তথ্য অবিশ্বাস করে। তার মৃত্যুর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বহু ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আবির্ভূত হয় এবং দীর্ঘকাল এগুলো তার মৃত্যু সম্পর্কে বিভিন্ন কল্পকাহিনী জীবিত রেখেছে।

তাইহোকুতে দুপুর আড়াইটার দিকে যখন সুভাষচন্দ্র বসু কে নিয়ে বোমারু বিমানটি উড্ডয়ন শুরু করে, তখনই এর যাত্রীরা বিমানের ইঞ্জিন থেকে একটি বিকট শব্দ শুনতে পান। রানওয়ের টারম্যাক থেকে কারিগরেরা বিমান থেকে কিছু পড়ে যেতে দেখেন। পড়ন্ত বস্তু ছিল পোর্টসাইড ইঞ্জিন অথবা এর একটি অংশ এবং প্রোপেলার। বিমানটি দ্রুত ডান দিকে ঝাঁকুনি দিয়ে এবং ভূমিতে বিধ্বস্ত হয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং আগুনে বিস্ফোরিত হয়। বিমানের ভেতরে, পাইলট, সহকারী পাইলট এবং জাপানি কোয়ান্তুং সেনাবাহিনীর ভাইস চিফ অফ স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল সুনামাসা শিদেই, যার সুভাষচন্দ্র বসুর পক্ষে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর সাথে মাঞ্চুরিয়ায় আলোচনা করার কথা ছিল, তাৎক্ষণিকভাবে নিহত হন। সুভাষচন্দ্র বসুর সহচর হাবিবুর রহমান কিছু সময়ের জন্য অচেতন হয়ে যান এবং বসু চেতনা না হারালেও তার দেহ জ্বালানিতে সিক্ত হয়ে ওঠে। রহমান চেতনা ফিরে পাওয়ার পর তারা পিছনের দরজা দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তারপর তারা আগুনের মধ্য দিয়েই দৌড়ে সামনে দিয়ে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বন্দরের লোকেরা বিমানের কাছে এসে দেখেন, দুজন লোক তাদের দিকে ছুটে আসছে, যাদের মধ্যে একজনের শরীরে আগুন জ্বলছে। এই ব্যক্তিটি ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। তার পোশাক জ্বালানি চুঁইয়ে তাৎক্ষণিকভাবে প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে। রহমান এবং অন্য কয়েকজন মিলে আগুন নেভাতে সক্ষম হলেও লক্ষ করেন যে সুভাষচন্দ্রের মুখ ও মাথা গুরুতরভাবে দগ্ধ হয়েছে। জয়েস লেব্রার মতে, "একটা লরি যেটা অ্যাম্বুল্যান্স হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছিল, তা দ্রুত সুভাষচন্দ্র এবং অন্য যাত্রীদের তাইহোকুর দক্ষিণে নানমোন সৈনিক হাসপাতালে নিয়ে যায়।" বিমান বন্দরের কর্মচারীরা বেলা তিনটা নাগাদ হাসপাতালের সার্জেন-ইন-চার্জ ডা. তানেয়োশি ইয়োশিমির সাথে যোগাযোগ করেন। তারা হাসপাতালে পৌছানোর সময় ও তার কিছুক্ষণ পরও সুভাষচন্দ্র বসু সচেতন ও সংহত ছিলেন। ডা. ইয়োশিমি এসে তৎক্ষণাৎ দেখলেন বসুর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ, বিশেষত তার বুকে তৃতীয় মাত্রার দহন (থার্ড ডিগ্রি বার্ন) সংঘটিত হয়েছে, এতে তার সন্দেহ হয় যে বসু বাঁচবেন কী না। ডা. ইয়োশিমি তৎক্ষণাৎ বসুর চিকিৎসা শুরু করেন এবং তাকে সাহায্য করেন ডা. সুরুতা। পরবর্তীতে হাসপাতালের কর্মচারীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী ঐতিহাসিক লিওনার্ড গর্ডন এর বক্তব্য হল:

একটা জীবাণুনাশক, রিভামল, তার শরীরের অধিকাংশ স্থানে লাগানো হয় এবং এরপর একটি সাদা মলম প্রয়োগ করে তার শরীরের অধিকাংশে ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হয়। ডা. ইয়োশিমি, বসুর হৃদয়ের দুর্বলতার জন্য চারটি ভিটা ক্যাম্ফর এবং দুটো ডিজিটামাইন ইঞ্জেকশন দেন। এগুলো ৩০ মিনিট অন্তর অন্তর দেওয়া হয়েছিল। যেহেতু পুড়ে যাওয়ার কারণে তার শরীরের জলীয় পদার্থ কমে যায় তাই তাকে ধমনীর মাধ্যমে রিঙ্গার সলিউশন দেওয়া হয়। একজন তৃতীয় ডাক্তার, ডা. ইশি, তাকে রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। একজন সৈনিক ও আর্দালী কাজুও মিতসুই সেই ঘরে উপস্থিত ছিলেন এবং কয়েকজন নার্স চিকিৎসায় সহায়তা করছিলেন। তখনো সুভাষচন্দ্রের পরিপূর্ণ চেতনা ছিল যা এরূপ গুরুতর আহত ব্যক্তির পক্ষে চমকপ্রদ বলে ড. ইয়োশিমি মনে করেন।

এই চিকিৎসা সত্ত্বেও, শীঘ্রই সুভাষচন্দ্র বসু কোমায় চলে যান। কয়েক ঘণ্টা পর, ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট, শনিবার, রাত নয়টা থেকে দশটার মধ্যে (স্থানীয় সময়), ৪৮ বছর বয়স্ক সুভাষচন্দ্র বসু মৃত্যুবরণ করেন।

দুদিন পর, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২০ আগস্ট, তাইহোকু শ্মশানে সুভাষচন্দ্র বসুর মরদেহ দাহ করা হয়। যদিও তার মৃত দেহ কাউকে দেখানো হয়নি, এমনকি, মৃতদেহের কোনো ছবিও তোলা হয়নি। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৩ অগস্ট জাপানি সংবাদ সংস্থা কর্তৃক সুভাষচন্দ্র এবং শিদেয়ার মৃত্যুর খবর ঘোষণা করা হয়। ৭ সেপ্টেম্বর, একজন জাপানি অফিসার লেফটেন্যান্ট তাতসুও হায়াশিদা সুভাষচন্দ্রের চিতাভস্ম টোকিওতে বয়ে নিয়ে যান এবং পরদিন সকালে তা টোকিওর ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের সভাপতি রামা মূর্তির হাতে তুলে দেন। ১৪ সেপ্টেম্বর টোকিওতে সুভাষচন্দ্র বসুর জন্য একটি স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং তার কয়েকদিন পর তার চিতাভস্ম টোকিওর নিচিরেন বৌদ্ধধর্ম সম্প্রদায়ের রেনকোজি মন্দির এর সন্ন্যাসীর কাছে জমা দেওয়া হয়। এরপর থেকে তা সেখানেই স্থায়ীভাবে রাখা হয়েছে।

সুভাষচন্দ্র বসু 
টোকিওর রেনকোজি মন্দিরে সুভাষচন্দ্র বসুর স্মৃতিস্তম্ভ।

আজাদ হিন্দ ফৌজের কর্মীদের মধ্যে, সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু নিয়ে ব্যাপক অবিশ্বাস ও বিহ্বলতা বিরাজ করছিল। সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হন মালয় এবং সিঙ্গাপুরের তরুণ তামিল ভারতীয়রা (নারী ও পুরুষ উভয়েই), যারা আজাদ হিন্দ ফৌজে তালিকাভুক্ত বেসামরিক নাগরিকদের সিংহভাগ গঠন করেছিল। এসময় আজাদ হিন্দ ফৌজ এর পেশাদার সৈন্যরা, যাদের অধিকাংশই পাঞ্জাবি, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সম্মুখীন হন। অনেকে আবার ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে ভয়াবহ প্রতিশোধ প্রত্যাশা করতে শুরু করেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আনুষ্ঠানিক অবস্থান, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী কর্তৃক অমৃতা কাউর এর উদ্দ্যেশ্যে লেখা একটি চিঠির মাধ্যমেই সংক্ষেপে প্রকাশ করা যায়: "সুভাষ বসু ভালোভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি বিপথগামী হওয়া সত্ত্বেও নিঃসন্দেহে একজন দেশপ্রেমিক ছিলেন।" গান্ধীর সঙ্গে বিবাদ এবং যাকে তারা জাপানি ফ্যাসিবাদ বলে বিবেচনা করে তার সঙ্গে হাত মেলানোর জন্য কংগ্রেসের অনেক সদস্যই সুভাষচন্দ্রকে ক্ষমা করতে পারেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রায় ২৫ লক্ষ ভারতীয় সৈন্য আজাদ হিন্দ ফৌজ সম্পর্কে দ্বিধান্বিত ছিল। অনেকে আজাদ হিন্দ ফৌজ এর সদস্যদের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে দেখতো এবং চাইতো যে তাদের শাস্তি হোক, আবার অন্যরা তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করতো। ব্রিটিশ রাজ, আজাদ হিন্দ ফৌজ কে গুরুতর হুমকি মনে না করলেও, এর ৩০০ অফিসারের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য বিচার শুরু করে, কিন্তু পরিশেষে তা থেকেও পিছিয়ে আসে।  

রাজনৈতিক চিন্তাধারা

সুভাষচন্দ্র বসু 
সুভাষচন্দ্র বসু ও মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী
সুভাষচন্দ্র বসু 
সুভাষচন্দ্র বসু ও মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ

বিখ্যাত উক্তি

সুভাষচন্দ্র বসুর সবচেয়ে বিখ্যাত উক্তি হল, "তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব"। তাঁর আরও একটি বিখ্যাত উক্তি হল "দিল্লি চলো" যা তিনি আইএনএ সেনাবাহিনীকে অনুপ্রাণিত করার জন্য বলতেন। জয় হিন্দ তার ব্যবহৃত আরও একটি স্লোগান, যা পরবর্তিতে ভারত সরকার এবং ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল। তাঁর উদ্ভাবিত আরও একটি স্লোগান ছিল "ইত্তেহাদ, এতেমাদ, কুরবানী"। এছাড়া আজাদ হিন্দ ফৌজে "ইনকিলাব জিন্দাবাদ" স্লোগানটি ব্যবহার করেছিলেন, এটি মওলানা হযরত মোহানি দ্বারা নির্মিত হয়েছিল।

সম্মাননা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুভাষচন্দ্রকে ' দেশনায়ক ' আখ্যা দিয়ে তাসের দেশ নৃত্যনাট্যটি তাকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গপত্রে লেখেন: "স্বদেশের চিত্তে নূতন প্রাণ সঞ্চার করবার পূণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ, সেই কথা স্মরণ ক’রে তোমার নামে ‘তাসের দেশ’ নাটিকা উৎসর্গ করলুম।" আজাদ হিন্দ ফৌজের অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলেও, সুভাষচন্দ্রের শৌর্য ও আপোষহীন রণনীতি তাকে ভারতব্যাপী জনপ্রিয়তা দান করে। নেতাজির জন্মদিন বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে, ত্রিপুরায়, অসমেওডিশায় রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। স্বাধীনতার পর কলকাতার একাধিক রাস্তা তার নামে নামাঙ্কিত করা হয়। বর্তমানে কলকাতার একমাত্র ইন্ডোর স্টেডিয়াম নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম তার নামে নামাঙ্কিত। নেতাজির জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে দমদম বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তিত করে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রাখা হয়। তার নামে কলকাতায় স্থাপিত হয় নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও নেতাজি সুভাষ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং দিল্লিতে স্থাপিত হয় নেতাজি সুভাষ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিকলকাতা মেট্রোর দুটি স্টেশন বর্তমানে নেতাজির নামাঙ্কিত: 'নেতাজি ভবন' (পূর্বনাম ভবানীপুর) ও 'নেতাজি' (পূর্বনাম কুঁদঘাট)।

কিংবদন্তি

স্মৃতি

সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৬৪,১৯৯৩, ১৯৯৭, ২০০১, ২০১৬ এবং ২০১৮ সালে ভারতের ডাকটিকিটে নির্বাচিত ছিলেন। এছাড়া তিনি ১৯৯৬ এবং ১৯৯৭ সালে ভারতীয় ₹২ কয়েনে নির্বাচিত ছিলেন। এছাড়া তিনি ২০১৮ ₹ ৭৫ কয়েনে এবং ২০২১ সালে ₹১২৫ কয়েনেও নির্বাচিত ছিলেন। কলকাতাতে রয়েছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু দ্বীপ (রোস দ্বীপ) এবং কিছু ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের নাম তার নামে নামকরণ করা হয়েছিল। ২৩ আগস্ট ২০০৭ সালে, জাপানের প্রধানমন্ত্রী, শিনজো আবে কলকাতায় সুভাষচন্দ্র বসুর স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন করেন। আবে বসু পরিবারকে বলেছিল, "জাপানিরা বসুর দৃঢ় ইচ্ছা শক্তি দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে ব্রিটিশ শাসনে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতেন। নেতাজি জাপানে অনেক শ্রদ্ধেয় নাম।"

২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি ভারত সরকার ঘোষণা দেয়, সুভাষচন্দ্র বসুর নেতাজি জয়ন্তী জন্মবার্ষিকী স্মরণের জন্য। রাজনৈতিক দল, বামফ্রন্ট এবং বামফ্রন্ট দাবি করেছিল যে, দিনটি দেশপ্রেম দিবস হিসাবে পালন করা উচিত।

জনপ্রিয় গণমাধ্যমে

অন্যান্য

আরও দেখুন

পাদটীক

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

Tags:

সুভাষচন্দ্র বসু জীবনীসুভাষচন্দ্র বসু কর্মজীবন ও রাজনীতিতে প্রবেশসুভাষচন্দ্র বসু ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনীসুভাষচন্দ্র বসু মৃত্যুসুভাষচন্দ্র বসু রাজনৈতিক চিন্তাধারাসুভাষচন্দ্র বসু বিখ্যাত উক্তিসুভাষচন্দ্র বসু সম্মাননাসুভাষচন্দ্র বসু কিংবদন্তিসুভাষচন্দ্র বসু আরও দেখুনসুভাষচন্দ্র বসু পাদটীকসুভাষচন্দ্র বসু তথ্যসূত্রসুভাষচন্দ্র বসু বহিঃসংযোগসুভাষচন্দ্র বসুচিত্র:Bn-নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু.ogaভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনমোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

মুজিবনগরসয়াই মানসিং স্টেডিয়ামবাংলাদেশের জেলাসমূহের তালিকাবাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজান্নাতুল ফেরদৌস পিয়াযোনি পিচ্ছিলকারকপ্লাস্টিক দূষণকলাযোনিলেহনদ্য কোকা-কোলা কোম্পানিবাসকটাঙ্গাইল জেলাবিশেষণবাংলাদেশের জাতিগোষ্ঠীঅশ্বত্থামাভারততাপপ্রবাহআন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসআলবার্ট আইনস্টাইনপৃথিবীমঙ্গোল সাম্রাজ্যদ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনঋতুআয়তন অনুযায়ী এশিয়ার দেশসমূহের তালিকাশ্রীকৃষ্ণকীর্তনই-মেইলজয়নুল আবেদিনপ্রাকৃতিক ভূগোলভারতের রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলসমূহমুসাফিরের নামাজইসলামি সহযোগিতা সংস্থাভেষজ উদ্ভিদহিমালয় পর্বতমালাআমার সোনার বাংলাপদ (ব্যাকরণ)বেল (ফল)নামের ভিত্তিতে মৌলসমূহের তালিকালক্ষ্মীপুর জেলাবায়ুমণ্ডলচৈতন্য মহাপ্রভুলোকসভাওমানআগ্নেয়গিরিসুনীল নারাইনরঙের তালিকাকারিনা কাপুরকিরগিজস্তানকালো জাদুআওরঙ্গজেবচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়শাবনূরহারুন-অর-রশিদ (পুলিশ কর্মকর্তা)পাখিমুঘল সাম্রাজ্যকৃত্তিবাসী রামায়ণদুবাই আমিরাতমনসামঙ্গলপ্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরজৈন ধর্মআন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসরক্তশূন্যতাম্যালেরিয়াশ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়সিলেট জেলাচৈতন্যভাগবতঅমর সিং চমকিলাউত্তম কুমারদোয়া কুনুতহানিফ সংকেতজিৎ (অভিনেতা)পাকিস্তানব্যষ্টিক অর্থনীতিইহুদি ধর্মবাংলাদেশ বিমান বাহিনীপানিপথের প্রথম যুদ্ধআরবি বর্ণমালানিপুণ আক্তার🡆 More