লালবাগের কেল্লা: মুঘল স্থাপত্য

লালবাগ কেল্লা (আওরঙ্গবাদ কেল্লা) ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত একটি অসমাপ্ত মুঘল দুর্গ। এটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৬৭৮ সালে, মুঘল সুবেদার মুহাম্মদ আজম শাহ কর্তৃক, যিনি ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র এবং পরবর্তীতে নিজেও সম্রাট পদপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু পরে তিনি দিল্লিতে চলে যান এতে কাজ থেমে যায়। তার উত্তরসুরি, মুঘল সুবাদার শায়েস্তা খাঁ ১৬৮০ সালে নির্মাণকাজ পুনরায় শুরু করেন, কিন্তু শেষ করেননি। কারণ মুঘল সুবাদার শায়েস্তা খাঁ এর কন্যা পরী বিবি মারা যান। এ কারণে তিনি নির্মাণ কাজ থামিয়ে দেন।

লালবাগ কেল্লা
লালবাগের কেল্লা: ইতিহাস, অবকাঠামো, দুর্গের কিছু দৃশ্য
লালবাগ কেল্লার সম্মুখ দৃশ্য
প্রাক্তন নামকিলা আওরঙ্গবাদ
সাধারণ তথ্য
অবস্থাএকটি অসমাপ্ত মুঘল দুর্গ স্থাপনা। বর্তমানে জাদুঘর ও ঐতিহাসিক নিদর্শন
ধরনদুর্গ স্থাপনা
স্থাপত্য রীতিমুঘল স্থাপত্য
ঠিকানালালবাগ, ঢাকা ১২১১
স্থানাঙ্ক২৩°৪৩′০৮″ উত্তর ৯০°২৩′১৭″ পূর্ব / ২৩.৭১৯০° উত্তর ৯০.৩৮৮১° পূর্ব / 23.7190; 90.3881
নির্মাণকাজের আরম্ভ১৬৭৮
নির্মাণকাজের প্রাক্কলিত সমাপ্তি১৬৮৪
স্বত্বাধিকারীপ্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
মাত্রা
অন্যান্য মাত্রাদেওয়ান-ই-আম: বাহ্যিক পরিমাপ ৩২.৪৭ মিটার x ৮.১৮ মিটার (১০৭’ x ২৯’)
পরী বিবির সমাধি: ২০.২ মিটার, বর্গাকৃতি
শাহী মসজিদ: আয়তাকার, (১৯.১৯ মি: × ৯.৮৪ মি)
নকশা এবং নির্মাণ
স্থপতিমুহাম্মদ আজম শাহ্
উপাধিবাদশাহ-ই-মুমালিক আবুল ফায়েজ কুতুবুদ্দিন মুহাম্মদ আজম শাহ-ই-আলি জাহ গাজী

ইতিহাস

লালবাগের কেল্লা: ইতিহাস, অবকাঠামো, দুর্গের কিছু দৃশ্য 
লালবাগ কেল্লার দরবার হলের মধ্যকার জাদুঘরের প্রদর্শিত শিলালিপি।
১৭৮৭ সালে দক্ষিণ গেট। জোহান যোফ্ফানির আঁকা
১৮৭৫ সালে দক্ষিণ গেট

সম্রাট আওরঙ্গজেবের ৩য় পুত্র, মুঘল রাজপুত্র আজম শাহ বাংলার সুবেদার থাকাকালীন ১৬৭৮ সালে এটার নির্মাণকাজ শুরু করেন। তিনি বাংলায় ১৫ মাস ছিলেন। দুর্গের নির্মাণকাজ শেষ হবার আগেই মারাঠা বিদ্রোহ দমনের জন্য পিতা সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে দিল্লি ডেকে পাঠান। এসময় একটি মসজিদ ও দরবার হল নির্মাণের পর দুর্গ নির্মাণের কাজ থেমে যায়। সুবেদার শায়েস্তা খাঁ ১৬৮০ সালে পুনরায় বাংলার সুবেদার হিসেবে ঢাকায় এসে দুর্গের নির্মাণকাজ পুনরায় শুরু করেন। ১৬৮৪ সালে এখানে শায়েস্তা খাঁর কন্যা ইরান দুখত রাহমাত বানুর (পরী বিবি) মৃত্যু ঘটে। কন্যার মৃত্যুর পর শায়েস্তা খাঁ এ দুর্গটিকে অপয়া মনে করেন এবং ১৬৮৪ খ্রিষ্টাব্দে অসমাপ্ত অবস্থায় এর নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেন। লালবাগের কেল্লার তিনটি প্রধান স্থাপনার একটি হল পরী বিবির সমাধি। শায়েস্তা খাঁ ঢাকা ত্যাগ করার পর এটি এর জনপ্রিয়তা হারায়। ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থানান্তর করা হয়েছিল; এটিই ছিল প্রধান কারণ। রাজকীয় মুঘল আমল সমাপ্ত হওয়ার পর দুর্গটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়ে যায়। ১৮৪৪ সালে এলাকাটি "আওরঙ্গবাদ" নাম বদলে "লালবাগ" নাম পায় এবং দুর্গটি পরিণত হয় লালবাগ দুর্গে ।

অবকাঠামো

দীর্ঘ সময় যাবত এটি ধারণা করা হত যে, দুর্গটি হচ্ছে তিনটি ভবন স্থাপনার সমন্বয় (মসজিদ, পরী বিবির সমাধি ও দেওয়ান-ই-আম), সাথে দুটি বিশাল তোরণ ও আংশিক ধ্বংসপ্রাপ্ত মজবুত দুর্গ প্রাচীর। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক উৎখননে অন্যান্য অবকাঠামোর অস্তিত্ব প্রকাশ পেয়েছে।

দক্ষিণস্থ দুর্গ প্রাচীরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটি বিরাট বুরূজ ছিল। দক্ষিণস্থ দুর্গ প্রাচীরের উত্তরে ছিল কয়েকটি ভবন, আস্তাবল, প্রশাসনিক ভবন, এবং পশ্চিম অংশে জলাধার ও ফোয়ারা সহ একটি সুন্দর ছাদ-বাগানের ব্যবস্থা ছিল।

আবাসিক অংশটি ছিল দুর্গ প্রাচীরের পশ্চিম-পূর্বে, প্রধানত মসজিদটির দক্ষিণ-পশ্চিমে।

দক্ষিণের দুর্গ প্রাচীরে নির্দিষ্ট ব্যবধানে ৫ টি বুরুজ ছিল উচ্চতায় দুই তালার সমান, এবং পশ্চিমের দুর্গ প্রাচীরে ছিল ২ টি বুরুজ যার সবচেয়ে বড়টি ছিল দক্ষিণস্থ প্রধান প্রবেশদ্বারে।

বুরুজ গুলোর ছিল একটি ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ। কেল্লাটির কেন্দ্রীয় এলাকা দখল করে ছিল তিনটি প্রধান ভবন। পূর্বে দেওয়ান-ই-আম ও হাম্মাম খানা, পশ্চিমে মসজিদটি এবং পরী বিবির সমাধি দুটোর মাঝখানে এক লাইনে, কিন্তু সমান দূরত্বে নয়। নির্দিষ্ট ব্যবধানে কয়েকটি ফোয়ারা সহ একটি পানির নালা তিনটি ভবনকে পূর্ব থেকে পশ্চিমে ও উত্তর থেকে দক্ষিণে সংযুক্ত করেছে।

দেওয়ান-ই-আম

লালবাগের কেল্লা: ইতিহাস, অবকাঠামো, দুর্গের কিছু দৃশ্য 
দেওয়ান-ই-আম এবং এর সাথে সংযুক্ত হাম্মামের পেছনের অংশ । দেওয়ান-ই-আম বাংলার মুঘল গভর্নরদের দরবার ও বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

হাম্মাম খানা মূলত সুবেদারদের বাস ভবন হিসেবে ব্যবহার হত । লালবাগ কেল্লার এই দালান কে দুটি কাজে ব্যবহার করা হতঃ হাম্মাম খানা (বাস ভবন হিসেবে), দেওয়ানে আম (বিচারালয় হিসেবে)। এই দালানের নিচ তালা ছিল বাস ভবন তথা হাম্মাম খানা আর উপরের তলা ছিল আদালত বা দেওয়ানে আম। শায়েস্তা খাঁ এই ভবনে বাস করতেন এবং এটাই ছিল তার আদালত। এখান থেকে তিনি সমস্ত বিচারকার্য পরিচালনা করতেন ।

পরীবিবির সমাধি

লালবাগ কেল্লার তিনটি স্থাপনার মধ্যে অন্যতম এটি। এখানে পরী বিবি সমাহিত আছেন। শায়েস্তা খান তার কন্যার স্মরণে এই মনমুগ্ধকর মাজারটি নির্মাণ করেন। লালবাগ কেল্লার তিনটি বিশাল দরজার মধ্যে বর্তমানে জনসাধারণের জন্যে উন্মুক্ত । এই দরজা দিয়ে ঢুকলে বরাবর সোজা চোখে পড়ে পরী বিবির সমাধি। আসলে "লালবাগ কেল্লা" বলতে যেই ছবিটি বেশি পরিচিত সেটি মূলত পরী বিবির সমাধির ছবি। পরী বিবি যার অন্য নাম ইরান দুখত রহমত বানু ছিলেন সুবাহ বাংলার মুঘল সুবেদারশায়েস্তা খানের কন্যা। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র শাহজাদা মুহাম্মদ আজমের সাথে ১৬৬৮ সালের ৩ মে পরী বিবির বিয়ে হয়। ১৬৮৪ সালে পরী বিবির অকালমৃত্যুর পর তাকে নির্মাণাধীন লালবাগ কেল্লার অভ্যন্তরে সমাহিত করা হয়। তার সমাধীস্থলকে চিহ্নিত করে পরী বিবির মাজার নির্মিত হয়। পরী বিবির মাজারের স্থাপনাটি চতুষ্কোণ। মার্বেল পাথর, কষ্টি পাথর ও বিভিন্ন রং এর ফুল-পাতা সুশোভিত চাকচিক্যময় টালির সাহায্যে অভ্যন্তরীণ নয়টি কক্ষ অলংকৃত করা হয়েছিল। মাঝের একটি ঘরে পরী বিবির সমাধিস্থল এবং এই ঘরটি ঘিরে আটটি ঘর আছে। স্থাপনাটির ছাদ করবেল পদ্ধতিতে কষ্টি পাথরে তৈরি এবং চারকোণে চারটি অষ্টকোণ মিনার ও মাঝে একটি অষ্টকোণ গম্বুজ আছে। মূল সমাধিসৌধের কেন্দ্রীয় কক্ষের উপরের এই গম্বুজটি একসময়ে স্বর্ণখচিত ছিল, পরবর্তীতে পিতলের/তামার পাত দিয়ে পুরো গম্বুজটিকে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। স্থাপনাটির অভ্যন্তর ভাগ সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে আচ্ছাদিত ছিল। ২০.২ মিটার বর্গাকৃতির এই সমাধিটি ১৬৮৮ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে নির্মিত। তবে বিশেষজ্ঞদের অভিমত বর্তমানে এখানে পরি বিবির মরদেহ নেই বলে।

শাহী মসজিদ

লালবাগের কেল্লা: ইতিহাস, অবকাঠামো, দুর্গের কিছু দৃশ্য 
তিন গম্বুজওয়ালা মসজিদ

সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র শাহজাদা আজম বাংলার সুবাদার থাকাকালীন তিন গম্বুজওয়ালা দুর্গ মসজিদ এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন ১৬৭৮-৭৯ খ্রিষ্টাব্দে। আয়তাকারে (১৯.১৯ মি: × ৯.৮৪ মি) নির্মিত তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি এদেশের প্রচলিত মুঘল মসজিদের একটি আদর্শ উদাহরণ। বর্তমানেও মসজিদটি মুসল্লিদের নামাজের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

পানির ট্যাংক

একটি বর্গাকৃতির পানির ট্যাংক (প্রতি পাশে ৪৫ মি) দেওয়ান-ই-আমের পূর্বদিকে স্থাপন করা হয়। সেখানে ট্যাংকে নামার জন্য চার কোণার সিঁড়ি আছে।

দুর্গের কিছু দৃশ্য

কেল্লা জাদুঘর

শায়েস্তা খাঁর বাসভবন ও দরবার হল বর্তমানে লালবাগ কেল্লা জাদুঘর হিসেবে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত।

বর্তমান অবস্থা

বর্তমানে এটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন অনেক দেশি বিদেশি পর্যটক এখানে ঘুরতে আসেন।

চিত্রশালা

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

Tags:

লালবাগের কেল্লা ইতিহাসলালবাগের কেল্লা অবকাঠামোলালবাগের কেল্লা দুর্গের কিছু দৃশ্যলালবাগের কেল্লা কেল্লা জাদুঘরলালবাগের কেল্লা বর্তমান অবস্থালালবাগের কেল্লা চিত্রশালালালবাগের কেল্লা আরও দেখুনলালবাগের কেল্লা তথ্যসূত্রলালবাগের কেল্লা বহিঃসংযোগলালবাগের কেল্লাঢাকাবুড়িগঙ্গা নদীমুহাম্মদ আজম শাহশায়েস্তা খাঁসম্রাট আওরঙ্গজেব

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

পায়ুসঙ্গমআবহাওয়াপশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন, ২০২১সিফিলিসসুলতান সুলাইমানবাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরতরমুজব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনশিক্ষকদেশ অনুযায়ী ইসলামইন্দিরা গান্ধীপাগলা মসজিদবিকাশনৃত্যমেয়েফরাসি বিপ্লবঅলিউল হক রুমিবর্তমান (দৈনিক পত্রিকা)বঙ্গাব্দবাঙালি হিন্দুদের পদবিসমূহআযানশিব নারায়ণ দাসজৈন ধর্মদৈনিক প্রথম আলোইন্টারনেটহিন্দুধর্মের ইতিহাসসিঙ্গাপুরমুঘল সাম্রাজ্যসমকামিতাজার্মানিবাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়বাংলাদেশের প্রশাসনিক অঞ্চলচণ্ডীদাসসন্ধিদ্বাদশ জাতীয় সংসদ সদস্যদের তালিকাবাংলাদেশের জেলাসমূহের তালিকাগায়ত্রী মন্ত্রইসলামের ইতিহাসমহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলসংস্কৃতিযৌনপল্লিবঙ্গভঙ্গ আন্দোলনসুকান্ত ভট্টাচার্যসত্যজিৎ রায়আরবি ভাষাকৃষ্ণচূড়াকানাডারাশিয়াবাংলাদেশের নদীর তালিকাবৃহস্পতি গ্রহআফ্রিকাক্রিস্তিয়ানো রোনালদোসরকারশিয়া ইসলামের ইতিহাসফেনী জেলাভারতীয় সংসদদুর্গাপূজাফিলিস্তিনের ইতিহাসবেদব্যাসজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সূরা ফাতিহাশাহ সিমেন্টদেব (অভিনেতা)সাইবার অপরাধপ্রাকৃতিক পরিবেশবাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাববিশ্বের মানচিত্রসুনীল নারাইনচট্টগ্রাম জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও দর্শনীয় স্থানঅগ্ন্যাশয়বাংলাদেশের ইউনিয়নবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সেক্টরসমূহওয়ালাইকুমুস-সালামনাঈমুল ইসলাম খানউত্তর চব্বিশ পরগনা জেলাটাঙ্গাইল জেলাবাংলা ব্যঞ্জনবর্ণ🡆 More