রামায়ণ: প্রাচীন সংস্কৃত মহাকাব্য

রামায়ণ একটি প্রাচীন সংস্কৃত মহাকাব্য। আদিকবি ঋষি বাল্মীকি রামায়ণের রচয়িতা। এই গ্রন্থটি বৈদিক শাস্ত্রের স্মৃতি বর্গের অন্তর্গত। রামায়ণ ও মহাভারত ভারতের দুটি প্রধান মহাকাব্য। এই কাব্যে বিভিন্ন সম্পর্কের পারস্পরিক কর্তব্য বর্ণনার পাশাপাশি আদর্শ পুত্র, আদর্শ ভ্রাতা, আদর্শ স্বামী ও আদর্শ রাজার চরিত্র চিত্রণের মাধ্যমে মানবসমাজের আদর্শ ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

রামায়ণ
রামায়ণ: পাঠ, চরিত্র, সংক্ষিপ্ত কাহিনী
পত্নী সীতা ও ভ্রাতা লক্ষ্মণের সঙ্গে বনবাসী রাম,
তথ্য
রচয়িতাবাল্মীকি
ভাষাসংস্কৃত
শ্লোক২৪,০০০

রামায়ণ নামটি রামঅয়ন শব্দদুটি নিয়ে গঠিত একটি তৎপুরুষ সমাসবদ্ধ পদ; যার আক্ষরিক অর্থ শ্রী রামের যাত্রা। রামায়ণ ৭টি কাণ্ড (পর্ব) ও ৫০০টি সর্গে বিভক্ত ২৪,০০০ শ্লোকের সমষ্টি। এই কাব্যের মূল উপজীব্য হল বিষ্ণুর অবতার রামের জীবনকাহিনী। বিষয়গতভাবে, রামায়ণ-উপাখ্যানে বর্ণিত হয়েছে মানব অস্তিত্বের নানান দিক এবং প্রাচীন ভারতের ধর্মচেতনা

রামায়ণের শ্লোকগুলি ৩২-অক্ষরযুক্ত অনুষ্টুপ ছন্দে রচিত। পরবর্তীকালের সংস্কৃত কাব্য এবং ভারতীয় জীবন ও সংস্কৃতিতে এই কাব্যের প্রভাব অপরিসীম। মহাভারত মহাকাব্যের মতোই রামায়ণও একটি কাহিনীমাত্র নয়: ভারতীয় ঋষিদের দার্শনিক শিক্ষা ও ভক্তি উপাদানসহ আখ্যানমূলক উপমার মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়েছে এই মহাকাব্যে। ভারতের সংস্কৃতি চেতনার মৌলিক উপাদানগুলিই প্রতিফলিত হয়েছে রাম, সীতা, লক্ষ্মণ, ভরত, হনুমান ও রাবণ চরিত্রগুলির মধ্যে। হিন্দুধর্মের বাইরে ও বহির্ভারতেও রামায়ণের কয়েকটি সংস্করণ প্রচলিত রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখনীয় বৌদ্ধ রামায়ণ দশরথ জাতক (জাতক সংখ্যা ৬৪১) ও জৈন রামায়ণ এবং রামায়ণের থাই, লাও, ব্রহ্মদেশীয় ও মালয় সংস্করণ।

পাঠ

রামায়ণ: পাঠ, চরিত্র, সংক্ষিপ্ত কাহিনী 
জোড়-বাংলা মন্দির বা কেষ্টরায় মন্দিরের রামায়ণ মোটিফ (১৬৫৫ খ্রি.), বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া জেলা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, ভারতের আদিকবি বাল্মীকি রামায়ণ রচনা করেছিলেন। ভারতীয় সংস্কৃতিতে এই ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই যে রামের সমসাময়িক তথা এই মহাকাব্যের অন্যতম চরিত্র ঋষি বাল্মীকি স্বয়ং এই মহাকাব্য রচনা করেছিলেন। সংস্কৃত ভাষায় রচিত রামায়ণের মূল পাঠটি বাল্মীকি রামায়ণ নামে পরিচিত। এই গ্রন্থের রচনাকাল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী। হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, রামায়ণ-উপাখ্যানের পটভূমি ত্রেতাযুগ নামে পরিচিত পৌরাণিক সময়কাল।

বর্তমানে সুলভ বাল্মীকি রামায়ণের সংস্করণটি মোটামুটি ৫০,০০০ পঙ্‌ক্তি সংবলিত। কয়েক হাজার আংশিক ও সম্পূর্ণ পুথিতে এই পাঠটি বর্তমানে সংরক্ষিত। এই পুথিগুলি মধ্যে সর্বপ্রাচীন পুথিটি খ্রিষ্টীয় একাদশ শতাব্দীতে লিখিত হয়। মূল রামায়ণের একাধিক আঞ্চলিক পাঠান্তর, সংস্করণ ও উপসংস্করণ বিদ্যমান। পুথিবিশারদ রবার্ট পি. গোল্ডম্যান এই সংস্করণগুলিকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা: (ক) উত্তর ভারতীয় ও (খ) দক্ষিণ ভারতীয়। এই সংস্করণগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তামিল ভাষায় কম্বন কর্তৃক রচিত রামাবতারম্ (খ্রিষ্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দী), অসমীয়া ভাষায় মাধব (ৱ) কন্দলি কৰ্তৃক ৰচিত সপ্তকাণ্ড রামায়ণ (খ্রিষ্টীয় চতুৰ্দশ শতাব্দী), বাংলা ভাষায় কৃত্তিবাস ওঝা কর্তৃক রচিত শ্রীরামপাঁচালী বা কৃত্তিবাসী রামায়ণ (খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দী) এবং হিন্দি ভাষার অবধি উপভাষায় তুলসীদাস গোস্বামী কর্তৃক রচিত রামচরিতমানস (খ্রিষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দী)। রামায়ণ বিশেষজ্ঞ তথা ইংরেজিতে রামায়ণের পদ্যানুবাদক রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেন, "মহাভারতের ন্যায় রামায়ণও বহু শতাব্দীর ফসল। কিন্তু নিঃসন্দেহে বলা যায়, এই কাব্যের মূল আখ্যানভাগটি একক ব্যক্তির মস্তিস্কপ্রসূত।"

অবশ্য বাল্মীকি রামায়ণের প্রথম ও শেষ কাণ্ডদুটি মূল রচয়িতা কর্তৃক রচিত কিনা সেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। রঘুনাথন মনে করেন, এই দুই কাণ্ডের কয়েকটি প্রক্ষিপ্তাংশ বর্তমানে মূল রামায়ণের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করা হলেও, গ্রন্থের অন্যান্য অংশের সঙ্গে এই অংশগুলির শৈলীগত পার্থক্য এবং আখ্যানগত স্ববিরোধ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।

রচনাকাল

বাল্মীকি রামায়ণের রচনাকাল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রমাণ (যেমন মহাভারতে সতীদাহ প্রথার উল্লেখ থাকলেও রামায়ণের মূল পাঠে তা নেই) থেকে অনুমিত হয় এই গ্রন্থ মহাভারতের পূর্বে রচিত হয়েছিল। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, হিন্দু কালপঞ্জিতে উল্লিখিত যুগপর্যায়ের দ্বিতীয় যুগ ত্রেতায় এই মহাকাব্য রচিত হয়। কথিত আছে, ত্রেতা যুগেই ইক্ষ্বাকু বংশীয় রাজা দশরথের পুত্র রামের জন্ম হয়।

তবে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেও রামায়ণকে প্রাচীনতর গ্রন্থ মনে করা হয়। রামায়ণে উল্লিখিত কয়েকটি চরিত্রনাম (যথা: রাম, সীতা, দশরথ, জনক, বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র) বৈদিক সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য অংশ ব্রাহ্মণ-এও পাওয়া যায়। এই গ্রন্থটি বাল্মীকি রামায়ণ অপেক্ষাও প্রাচীন। তবে প্রাপ্ত বৈদিক কাব্যসাহিত্যে কোথাও বাল্মীকির রামায়ণের অনুরূপ কোনো উপাখ্যানের সন্ধান পাওয়া যায় না। আধুনিক গবেষকগণের মতে, রামায়ণের অন্যতম প্রধান চরিত্র ব্রহ্মা ও বিষ্ণু (আদিকাণ্ড অনুসারে রাম যাঁর অবতার) বৈদিক দেবতা ছিলেন না। খ্রিষ্টীয় প্রথম সহস্রাব্দের শেষভাগে 'পৌরাণিক' যুগে তারা ভারতীয় জনসমাজে বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করেন। মহাভারত গ্রন্থে রামোপাখ্যান নামে রামায়ণের একটি সারাংশ সংযোজিত হয়েছে; যুধিষ্ঠিরের নিকট কথিত এই উপাখ্যানে রামের চরিত্রে কোনো দেবত্ব আরোপ করা হয়নি।

গবেষকেরা মনে করেন, রামায়ণের প্রথম পর্ব আদিকাণ্ড ও শেষ পর্ব উত্তরকাণ্ড পরবর্তীকালের সংযোজন। দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ কাণ্ড পর্যন্ত মহাকাব্যটিই প্রাচীন অংশ। আদিকাণ্ডউত্তরকাণ্ড-এর লেখক বা লেখকবৃন্দ উত্তর ভারতের পূর্ব গাঙ্গেয় সমভূমি এবং ষোড়শ মহাজনপদের যুগের কোশল ও মগধ রাজ্যের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। কারণ উক্ত অংশে এই সকল অঞ্চল সম্পর্কে প্রদত্ত ভৌগোলিক ও ভূরাজনৈতিক তথ্য এই অঞ্চলের ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। যদিও অরণ্যকাণ্ড থেকে রাক্ষসবধকারী নায়ক ও নানাপ্রকার পৌরাণিক জীবজন্তুর উপস্থিতিতে সহসাই এই উপাখ্যান কল্পকাহিনীমূলক হয়ে পড়েছে। মধ্য ও দক্ষিণ ভারতের ভৌগোলিক তথ্য এখানে অত্যন্ত অস্পষ্ট। লঙ্কা দ্বীপে ভৌগোলিক অবস্থানটিও স্পষ্ট করে বলা হয়নি। এই সকল তথ্যের উপর ভিত্তি করেই ঐতিহাসিক এইচ. ডি. সঙ্কলিয়া খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীকে এই মহাকাব্যের রচনাকাল বলে উল্লেখ করেন। এ. এল. ব্যাসাম অবশ্য এই মত প্রকাশ করেছেন যে রাম সম্ভবত ছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম অথবা সপ্তম শতাব্দীর এক ক্ষুদ্র গোষ্ঠীপতি।

চরিত্র

রামায়ণ: পাঠ, চরিত্র, সংক্ষিপ্ত কাহিনী 
সীতার পার্শ্বে উপবিষ্ট রাম, পশ্চাতে লক্ষ্মণ, ভরতশত্রুঘ্ন দণ্ডায়মান; সম্মুখে হনুমান ও অন্যান্য বানরেরা প্রণাম জানাচ্ছেন।
  • রাম – এই উপাখ্যানের নায়ক। বিষ্ণুর সপ্তম অবতার রাম ছিলেন রাজা দশরথ ও তার জ্যেষ্ঠা মহিষী কৌশল্যার জ্যৈষ্ঠ ও প্রিয়তম পুত্র। রামায়ণে রামকে মর্যাদা পুরুষোত্তম অর্থাৎ সর্বগুণের আধার বলে অভিহিত করা হয়েছে। দ্বিতীয়া স্ত্রী কৈকেয়ীর চক্রান্তে দশরথ রামকে চৌদ্দ বছরের জন্য বনবাসে যাওয়ার নির্দেশ দিতে বাধ্য হন। রামও পিতার আজ্ঞা শিরোধার্য করে বনবাসে গমন করেন।
  • সীতা – রামের প্রিয়তমা পত্নী এবং রাজা জনকের পালিতা কন্যা। সীতার অপর নাম জানকী। তিনি বিষ্ণুপত্নী দেবী লক্ষ্মীর অবতার। রামায়ণে তাকে নারীজাতির আদর্শস্থানীয়া বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি স্বামীর সঙ্গে বনবাসে গমন করেন। রাবণ তাকে অপহরণ করে লঙ্কায় বন্দী করে রাখেন। রাম রাবণকে পরাজিত করে তাকে উদ্ধার করেন। পরবর্তীকালে তিনি রামের দুই যমজ পুত্র লবকুশের জন্ম দেন।
  • হনুমানকিষ্কিন্ধ্যা রাজ্যের এক বানর। তিনি শিবের (একাদশ রুদ্র) অবতার এবং রামের আদর্শ ভক্ত। তার পিতা বানররাজ কেশরী ও মাতা অঞ্জনা। সীতার অবস্থান নির্ণয় ও উদ্ধার তথা লঙ্কার যুদ্ধে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন।
  • লক্ষ্মণ – রামের ভ্রাতা। সুমিত্রার পুত্র। তিনি স্বেচ্ছায় রাম ও সীতার সঙ্গে বনবাসে গমন করেন ও সেখানে তাদের রক্ষা করে চলেন। লক্ষ্মণ ছিলেন বিষ্ণুর সহচর শেষনাগের অবতার। মারীচের ছলনায় রামের বিপদাশঙ্কায় তিনি সীতাকে একাকী ফেলে যেতে বাধ্য হন। সেই সুযোগে রাবণ সীতাকে অপহরণ করেন।
  • রাবণলঙ্কার রাক্ষসরাজা। দশ হাজার বছর কঠোর তপস্যা করে তিনি সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার কাছ থেকে এই বর লাভ করেন যে কোনো দেব, দানব বা ভৌতিক জীব তাকে বধ করতে পারবেন না। তিনি ছিলেন এক শক্তিশালী রাক্ষসরাজা। ঋষিদের উপর অত্যাচার চালিয়ে করে তিনি বিশেষ আমোদ অনুভব করতেন। ব্রহ্মার বরদানকে এড়িয়ে তাকে হত্যা করার জন্য বিষ্ণুকে মানব রূপে জন্মগ্রহণ করতে হয়।
  • দশরথঅযোধ্যার রাজা ও রামের পিতা। তার তিন পত্নী: কৌশল্যা, কৈকেয়ীসুমিত্রা এবং রাম ব্যতীত অপর তিন পুত্র: ভরত, লক্ষ্মণশত্রুঘ্ন। দশরথের প্রিয়তমা পত্নী কৈকেয়ী তাকে বাধ্য করেন রামকে চৌদ্দ বছরের জন্য বনবাসে পাঠিয়ে ভরতকে যুবরাজ ঘোষণা করতে। রাম বনে গেলে পুত্রশোকে দশরথের মৃত্যু হয়।
  • ভরত – দশরথের পুত্র। যখন তিনি জানতে পারেন যে রামকে বনে পাঠানোর প্রধান চক্রী তার মা এবং তারই জন্য পুত্রশোকে পিতার মৃত্যু হয়েছে, তখন তিনি ঘৃণাভরে রাজপদ প্রত্যাখ্যান করে রামের অনুসন্ধানে বাহির হন। কিন্তু রাম প্রত্যাবর্তনে অসম্মত হলে, তিনি রামের পাদুকা(খড়ম) দুখানি চেয়ে নেন। সেই খড়ম দুটি সিংহাসনে স্থাপন করে পরবর্তী চৌদ্দ বছর রামের নামে অযোধ্যা শাসন করেছিলেন ভরত।
  • শত্রুঘ্ন – দশরথ ও সুমিত্রার পুত্র। তিনি রামের কনিষ্ঠ ও লক্ষ্মণের যমজ ভ্রাতা এবং শ্রুতকীর্তির পতি ।

সংক্ষিপ্ত কাহিনী

রামায়ণ সাতটি কাণ্ড বা খণ্ডে বিভক্ত। যথা: আদিকাণ্ড বা বালকাণ্ড, অযোধ্যাকাণ্ড, অরণ্যকাণ্ড, কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড, সুন্দরকাণ্ড, লঙ্কাকাণ্ড বা যুদ্ধকাণ্ডউত্তরকাণ্ড। এই সপ্তকাণ্ডে রামের জীবনকথা কালানুক্রমিকভাবে বর্ণিত হয়েছে। আদিকাণ্ড-এ বর্ণিত হয়েছে রামের জন্ম, শৈশব ও সীতার সহিত বিবাহের কথা; অযোধ্যাকাণ্ড-এ বর্ণিত হয়েছে রামের রাজ্যাভিষেক প্রস্তুতি ও তার বনগমনের কথা; তৃতীয় খণ্ড অরণ্যকাণ্ড-এ বর্ণিত হয়েছে রামের বনবাসের কথা ও রাবণ কর্তৃক সীতাহরণের বৃত্তান্ত; চতুর্থ খণ্ড কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড-এ বর্ণিত হয়েছে হনুমান ও রামের মিলন, রামের সহায়তায় বানররাজ বালী হত্যা এবং বালীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা সুগ্রীবের কিষ্কিন্ধ্যার রাজ্যাভিষেক; পঞ্চম খণ্ড সুন্দরকাণ্ড-এ বর্ণিত হয়েছে হনুমানের বীরত্বগাথা, তার লঙ্কাগমন ও সীতার সহিত সাক্ষাতের কথা; রাম ও রাবণের যুদ্ধ বর্ণিত হয়েছে ষষ্ঠ খণ্ড লঙ্কাকাণ্ড-এ; সর্বশেষ খণ্ড উত্তরকাণ্ড-এর মূল উপজীব্য রাম ও সীতার পুত্র লব ও কুশের জন্মবৃত্তান্ত, তাদের রাজ্যাভিষেক ও রামের ধরিত্রী ত্যাগ।

বালকাণ্ড বা আদিকাণ্ড

রামায়ণ: পাঠ, চরিত্র, সংক্ষিপ্ত কাহিনী 
দশরথের চার পুত্রের জন্ম

দশরথ ছিলেন কোশল রাজ্যের রাজা, তার রাজধানী ছিল অযোধ্যা নগরীতে। তার তিন মহিষী: কৌশল্যা, কৈকেয়ী ও সুমিত্রা। দীর্ঘদিন অপুত্রক অবস্থায় থাকার কারণে পুত্রকামনায় রাজা দশরথ পুত্র-কামেষ্টী বা পুত্রেষ্টী যজ্ঞের আয়োজন করেন। এরপরই কৌশল্যার গর্ভে রাম, কৈকেয়ীর গর্ভে ভরত এবং সুমিত্রার গর্ভে লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন নামে দুই যমজ পুত্রের জন্ম হয়। এই চারজনই ছিলেন বিষ্ণুর অংশসম্ভূত। রাবণ নামে এক অত্যাচারী রাক্ষসরাজাকে বধ করবার উদ্দেশ্যে বিষ্ণু মানবের রূপ ধারণ করে অবতার গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, ব্রহ্মার বরে এই রাবণ একমাত্র কোনো পরাক্রমী নশ্বর মানবের হাতেই বধ্য ছিলেন। চার রাজকুমার শস্ত্রবিদ্যা ও শাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। একদা ঋষি বিশ্বামিত্র দশরথের সভায় উপস্থিত হয়ে তার আশ্রমে উপদ্রব সৃষ্টিকারী রাক্ষসদের ধ্বংস করতে রাজার সহায়তা প্রার্থনা করেন। তিনি এই কাজের জন্য ষোড়শ-বর্ষীয় রামকে নির্বাচন করেন। রামের সঙ্গে যান তার ছায়াসঙ্গী লক্ষ্মণ। রাম ও লক্ষ্মণকে বিশ্বামিত্র বিশেষ শস্ত্রশিক্ষা ও নানান অলৌকিক অস্ত্রশস্ত্র প্রদান করেন। নবলব্ধ শিক্ষা ও অস্ত্রে বলীয়ান হয়ে রাম ও লক্ষ্মণ ঋষির আশ্রমে উপদ্রব সৃষ্টিকারী সকল রাক্ষসকে হত্যা করেন।

এই সময়ে মিথিলার রাজা ছিলেন জনক। একদিন ভূমিকর্ষণ করতে গিয়ে রাজা লাঙলের রেখায় একটি শিশুকন্যাকে কুড়িয়ে পান। আনন্দে অভিভূত রাজা এই কন্যাটিকে ঈশ্বরের দান মনে করে লালন পালন করতে থাকেন। তিনি এই কন্যার নামকরণ করেন সীতা। কারণ, সংস্কৃতে লাঙলের কর্ষণরেখাকে সীতা বলা হয়। সীতা বিবাহযোগ্যা হলে রাজা তার বিবাহের জন্য স্বয়ম্বরের আয়োজন করেন। শিব রাজা জনককে একটি ধনুক উপহার দিয়েছিলেন। রাজা পণ রাখেন যিনি এই ধনুকে গুণ সংযোজন করতে পারবেন, তাকেই অপরূপা সীতা পতিত্বে বরণ করবে। ঋষি বিশ্বামিত্র রাম ও লক্ষ্মণকে নিয়ে সেই স্বয়ম্বর সভায় উপস্থিত হলেন। কেবলমাত্র রামই সেই ধনুকে গুণ পরিয়ে তা ভঙ্গ করতে সমর্থ হলেন। রামের সঙ্গে সীতার বিবাহ হল। শুধু তাই নয়, দশরথের অন্যান্য পুত্রদের সঙ্গে জনকের অন্যান্য কন্যা ও ভাগিনেয়ীদের বিবাহ সম্পন্ন হল। মিথিলায় মহাসমারোহে বিবাহ উৎসব উদযাপিত হল। অতঃপর নববিবাহিত দম্পতি চতুষ্টয় অযোধ্যা নগরে প্রত্যাবর্তন করলেন।

অযোধ্যাকাণ্ড

রামায়ণ: পাঠ, চরিত্র, সংক্ষিপ্ত কাহিনী 
ভরত কর্তৃক রামের পাদুকা প্রার্থনা; বালাসাহেব পণ্ডিত পন্ত প্রতিনিধি অঙ্কিত চিত্র

রাম ও সীতার বিবাহের বারো বছর পর বৃদ্ধ রাজা দশরথ রামকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। কোশল রাজসভায় তার ইচ্ছাকে সকলেই সমর্থন করল। কিন্তু উক্ত অনুষ্ঠানের পূর্বসন্ধ্যায় দাসী মন্থরার কুমন্ত্রণায় কৈকেয়ীর ঈর্ষা জাগরিত হয়ে উঠল। বহুকাল পূর্বে রাজা দশরথ কৈকেয়ীকে দুটি বর দিতে প্রতিশ্রুত হয়েছিলেন। তার সুযোগ কৈকেয়ী রাজার কাছে দাবি করেন যে রামকে চোদ্দো বছরের জন্য বনবাসে পাঠাতে হবে এবং তার স্থলে ভরতকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করতে হবে। বৃদ্ধ ও হতাশ রাজা নিজ প্রতিজ্ঞা রক্ষার দায়েই কৈকেয়ীকে প্রার্থিত বরদুটি প্রদান করতে সম্মত হলেন। রাম পিতার আজ্ঞা স্বেচ্ছায় ও শান্তচিত্তে মেনে নিলেন। পত্নী সীতা ও ভ্রাতা লক্ষ্মণ তার সঙ্গী হলেন। রাম সীতাকে নিরস্ত করতে গেলে সীতা উত্তর দিলেন, "যে বনে তুমি বাস করবে, সে বনই আমার নিকট অযোধ্যা; কিন্তু যে অযোধ্যায় তুমি নেই, সে অযোধ্যা আমার নিকট দুঃসহ নরক।" রামের প্রস্থানের পর পুত্রশোকে কাতর হয়ে রাজা দশরথ দেহত্যাগ করলেন। এই ঘটনার সময় ভরত ছিলেন তার মাতুলালয় নন্দীগ্রামে। সব শুনে ভরত সত্বর অযোধ্যায় ফিরে এলেন। তিনি মায়ের কুটিল চক্রান্তে পাওয়া রাজপদ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেন। রামকে খুঁজতে খুঁজতে তিনি উপস্থিত হলেন বনে। তিনি রামকে অযোধ্যায় ফিরে রাজপদ গ্রহণের অনুরোধ জানালেন। কিন্তু পিতার আজ্ঞার বিরুদ্ধাচারণ করে চৌদ্দ বছর কাল উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তনে অসম্মত হলেন। ভরত তখন রামের খড়মদুটি চেয়ে নিলেন। রাজ্যে ফিরে সেই খড়মদুটিই সিংহাসনে স্থাপন করে রামের নামে রাজ্যশাসন করতে লাগলেন তিনি।

অরণ্যকাণ্ড

রামায়ণ: পাঠ, চরিত্র, সংক্ষিপ্ত কাহিনী 
রাবণ কর্তৃক জটায়ুর পক্ষচ্ছেদন, রাজা রবি বর্মা অঙ্কিত চিত্র

রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ দক্ষিণ দিকে যাত্রা করেন। গোদাবরী নদীর তীরে পঞ্চবটী বনে কুটির নির্মাণ করে সেখানেই বসবাস করতে থাকেন তারা। একদিন রাবণের ভগিনী শূর্পনখা সেই বনে ভ্রমণ করতে করতে রাম ও লক্ষ্মণের সাক্ষাৎ পেলেন। শূর্পনখা সুন্দরী রমণীর ছদ্মবেশে রাম ও লক্ষ্মণকে প্রলুব্ধ করতে গিয়ে ব্যর্থ হলেন। তখন ক্রোধে অন্ধ হয়ে সীতাকে ভক্ষণ করতে গেলে লক্ষ্মণ খড়্গাঘাতে শূর্পণখার নাসিকা ও কর্ণ ছেদন করলেন। শূর্পনখার অপর রাক্ষস ভ্রাতা খর ও দুষন এই সংবাদ পেয়ে সসৈন্যে রাম ও লক্ষ্মণকে আক্রমণ করলেন। কিন্তু রাম সসৈন্যেই বধ করলেন খর- দুষনকে।

রাবণ এই সংবাদ পেয়ে ভগিনীর অপমানের প্রতিশোধ কল্পে সীতাকে অপহরণ করার পরিকল্পনা করলেন। এই কাজে তাকে সাহায্য করলেন মারীচ নামে এক মায়াবী রাক্ষস। মারীচ স্বর্ণমৃগের ছদ্মবেশ ধরে সীতার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। হরিণটির রূপে মোহিত হয়ে তিনি রামের নিকট হরিণটি প্রার্থনা করে বসলেন। হরিণটিকে ধরতে গেলেন রাম। খানিকবাদে তিনি শুনতে পেলেন, রাম আর্তচিৎকার করছেন। আসলে মায়াবী মারীচ রামের কণ্ঠ নকল করে আর্তনাদ করেছিল। ভীত হয়ে সীতা লক্ষ্মণকে রামের সন্ধানে যেতে অনুরোধ করলেন। রাম যে অপরাজেয় সে কথা লক্ষ্মণ সীতাকে বারংবার বোঝাতে চাইলেন। কিন্তু সীতা সে কথায় কর্ণপাত করলেন না। অবশেষে কুটিরের চারিদিকে একটি গণ্ডী কেটে সীতাকে সেই গণ্ডীর বাইরে যেতে নিষেধ করে লক্ষ্মণ গেলেন রামের সন্ধানে। রাবণ এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন। তিনি ঋষির ছদ্মবেশে এসে সীতার নিকট ভিক্ষা প্রার্থনা করলেন। রাবণের ছলনা বুঝতে না পেরে সীতা গণ্ডীর বাইরে এসে তাকে ভিক্ষা দিতে গেলে দুষ্ট রাবণ বলপূর্বক সীতাকে অপহরণ করে নিজ রথে তুলে নিলেন।

জটায়ু নামে একটি শকুন জাতীয় রামভক্ত পক্ষী সীতার অপহরণ দেখতে পেয়ে সীতাকে উদ্ধার করতে গিয়ে রাবণের হাতে গুরুতর আহত এবং ভূপতিত হল। রাবণ সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে লঙ্কায় অশোক কানন নামক বনে নজরবন্দী করে একদল চেড়ীর (রাক্ষসী) তত্ত্বাবধানে রাখলেন। তিনি সীতাকে বিবাহ করতে চাইলেন। কিন্তু রামের প্রতি নিবেদিতপ্রাণা সীতা সেই কুপ্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেন। এদিকে রাম ও লক্ষ্মণ মৃত্যুপথযাত্রী জটায়ুর কাছে সীতাহরণের সংবাদ পেলেন এবং অবিলম্বে সীতাকে উদ্ধার করার জন্য যাত্রা করলেন। যাত্রাপথে শবরী নামে এক বৃদ্ধা তপস্বিনী তাদের সুগ্রীব ও হনুমানের সাহায্য নেওয়ার পরামর্শ দিলেন।

কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড

রামায়ণ: পাঠ, চরিত্র, সংক্ষিপ্ত কাহিনী 
রাম কর্তৃক বালীকে পিছন থেকে তীর ছুঁড়ে হত্যা

কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড-এর পটভূমি বানর রাজ্য কিষ্কিন্ধ্যা। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বানরবীর তথা সুগ্রীবের অনুগামী হনুমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল রাম ও লক্ষ্মণের। সুগ্রীব ছিলেন কিষ্কিন্ধ্যার নির্বাসিত এক রাজপদপ্রার্থী। রাম সুগ্রীবের সঙ্গে মিত্রতা করলেন। রাম এবং সুগ্রীব, বালীকে হত্যার জন্য পরিকল্পনা করলেন। তারা ঠিক করলেন যে যখন সুগ্রীব বালীকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করবে তখন রাম বালীকে হত্যা করবে। সেই পরিকল্পনা মতো সুগ্রীব বালীকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করলো এবং রাম তাকে পিছন থেকে তীর ছুঁড়ে হত্যা করলেন, কারণ ইন্দ্রের বরে বালীকে সামনে থেকে মারা অসম্ভব ছিল। তখন মরণাপন্ন বালী, রামকে প্রশ্ন করলো যে সে কেন তাকে হত্যা করলো? রাম তার প্রশ্নের উত্তরে বললেন যে সে অন্যায়ভাবে সুগ্রীবকে রাজ্যচ্যুত করে তার স্ত্রী তারাকে বলপূর্বক নিজের রানী করেছে। তাই এই অধর্মের ফলে তার মৃত্যু হলো। তখন বালী তার অন্যায় বুঝতে পারলো এবং মহানুভব রামের হাতে মৃত্যুর জন্য তাকে ধন্যবাদ দিয়ে মৃত্যুবরণ করলো। রামের সহায়তায় সুগ্রীব নিজভ্রাতা বালীকে হত্যা করে কিষ্কিন্ধ্যার সিংহাসনে আরোহণ করলেন। রামের সহায়তার বিনিময়ে সুগ্রীব চতুর্দিকে সীতার অনুসন্ধানে বানর দল পাঠালেন। উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিমগামী দলগুলি ব্যর্থ হয়ে ফিরে এল। অঙ্গদ ও হনুমানের নেতৃত্বাধীন দক্ষিণগামী দলটি শেষে সম্পাতি নামে এক শকুন জাতীয় পক্ষীর নিকট সংবাদ পেলেন যে রাবণ সীতাকে লঙ্কায় নিয়ে গিয়ে বন্দী করে রেখেছেন।

সুন্দরকাণ্ড

রামায়ণ: পাঠ, চরিত্র, সংক্ষিপ্ত কাহিনী 
অশোকবনে সীতারাবণের কথোপকথন দৃশ্য, বৃক্ষের উপর বসে সেই কথোপকথন শুনছেন হনুমান

সুন্দরকাণ্ড বাল্মীকি রামায়ণের কেন্দ্রীয় অংশ। এই অংশে হনুমানের অভিযানের একটি বিস্তারিত ও সুস্পষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায়। সম্পাতির নিকট সীতার সংবাদ পেয়ে হনুমান এক বিশাল শরীর ধারণ করে এক লাফে সাগর পার হয়ে লঙ্কায় উপস্থিত হলেন। লঙ্কায় এসে তিনি রাবণের প্রাসাদে গুপ্তচরবৃত্তি করলেন। অবশেষে অশোকবনে সীতার সন্ধান পেলেন তিনি। সীতাকে রাবণ ও চেড়ীরা বিবাহে রাজি করানোর জন্য ভয় দেখিয়ে উত্যক্ত করছিল। হনুমান, সীতাকে রামের আংটি ও বার্তা দিলেন। তিনি সীতাকে রামের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু সীতা রাজি হলেন না। তিনি বললেন, রাম যেন শীঘ্র এসে রাবণকে উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে তার অপমানের প্রতিশোধ নেন এবং তাকে উদ্ধার করেন।

অতঃপর হনুমান লঙ্কায় ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালালেন এবং রাবণের কয়েকজন যোদ্ধাকে বধ করলেন। তারপর ধরা দিয়ে রাবণের সম্মুখে উপস্থিত হলেন। রাবণের রাজসভায় দাঁড়িয়ে তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে রাবণকে উপদেশ দিলেন সীতাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু রাবণ তার কথায় কর্ণপাত না করে তার লেজে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার আদেশ দিলেন। এরপর হনুমান নিজের লেজের আগুনে সমগ্র লঙ্কাপুরী ভস্মীভূত করে ফিরে এলেন তার অপেক্ষমাণ দলের কাছে। উল্লসিত হয়ে তাদের দল কিষ্কিন্ধ্যায় ফিরে রামকে সীতার খবর দিলেন।

লঙ্কাকাণ্ড

রামায়ণ: পাঠ, চরিত্র, সংক্ষিপ্ত কাহিনী 
লঙ্কার যুদ্ধ, সাহিবদিন অঙ্কিত। এই চিত্রে দেখা যাচ্ছে রামের (উপরে বামদিকে, নীল বর্ণে) বানরসেনা রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। এই চিত্রে যুদ্ধের নানা দৃশ্য অঙ্কিত হয়েছে। নিচে বাঁদিকে ত্রিশিরার সঙ্গে বানরদের যুদ্ধের দৃশ্য আছে; হনুমান ত্রিশিরার শিরোশ্ছেদ করছেন।

এই খণ্ডে রাম ও রাবণের যুদ্ধের বিবরণ রয়েছে। হনুমানের নিকট সীতার সংবাদ পেয়ে রাম ও লক্ষ্মণ বানর সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে দক্ষিণ সমুদ্রের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। সমুদ্রতীরে রাবণের অনুতপ্ত ভ্রাতা বিভীষণ তাদের পক্ষে যোগ দিলেন। অঙ্গদ, জাম্বুবান, নল, নীল প্রমুখ বানরেরা সমুদ্রের উপর একটি সেতু বন্ধন করলেন। সেই সেতুপথে রাম সসৈন্যে লঙ্কায় প্রবেশ করলেন। এই সেতুটিই রামসেতু নামে পরিচিত। লঙ্কায় রাম ও রাবণের মধ্যে এক দীর্ঘ যুদ্ধ সংঘটিত হল। যুদ্ধান্তে রাবণ নিহত হলেন। রাম বিভীষণকে লঙ্কার সিংহাসনে স্থাপন করলেন।

সীতার সঙ্গে রামের মিলন হল। কিন্তু দীর্ঘদিন রাক্ষসগৃহে বসবাসকারী সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে সতীত্ব প্রমাণ করতে বললেন রাম। সীতা অগ্নিতে প্রবেশ করলেন। স্বয়ং অগ্নিদেব আবির্ভূত হয়ে রামের নিকট সীতার পবিত্রতার কথা ঘোষণা করলেন। অগ্নিপরীক্ষার উপাখ্যানটি বাল্মীকি ও তুলসীদাসের রামায়ণে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। যাই হোক, এরপর বনবাসের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়। রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ অযোধ্যায় ফিরে আসেন। সেখানে রামের রাজ্যাভিষেক হয়।

উত্তরকাণ্ড

রামায়ণ: পাঠ, চরিত্র, সংক্ষিপ্ত কাহিনী 
বাল্মীকির তপোবনে সীতা

উত্তরাকাণ্ড-এ বর্ণিত হয়েছে রাম, সীতা ও রামের ভ্রাতৃগণের শেষ জীবন। রাজা হওয়ার পর রাম অনেক কাল সীতাকে নিয়ে সুখে সংসার করেন। এদিকে অগ্নিপরীক্ষিতা হওয়া সত্ত্বেও সীতাকে নিয়ে অযোধ্যায় নানান গুজব ছড়াতে শুরু করে। এই সব রটনায় বিচলিত হয়ে রাম সীতাকে নির্বাসনে পাঠান। সন্তানসম্ভবা সীতা আশ্রয় নেন ঋষি বাল্মীকির আশ্রমে। সেখানেই তার যমজ পুত্রসন্তান লব ও কুশের জন্ম হয়। লব-কুশকে তাদের পিতৃপরিচয় জানানো হয় না। তারা গ্রহণ করে বাল্মীকির শিষ্যত্ব।

বাল্মীকি লব ও কুশকে রামায়ণ গান শিক্ষা দেন। ইতোমধ্যে রাম অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করলে বাল্মীকি লব ও কুশকে নিয়ে যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হন। লব ও কুশ সভায় রামায়ণ গান গেয়ে শোনান। সীতার বনবাসের গান শুনে রাম দুঃখিত হন। তখন বাল্মীকি সীতাকে নিয়ে আসেন রামের সম্মুখে। কিন্তু রাম সকলের সম্মুখে সীতাকে পুনরায় অগ্নিপরীক্ষা দিতে বললে অপমানিতা সীতা মাতা ধরিত্রীকে আহ্বান জানান। মাটি বিদীর্ণ হয়। দেবী ধরিত্রী উঠে এসে সীতাকে নিয়ে পাতালে চলে যান। এরপর রাম জানতে পারেন যে লব ও কুশ আসলে তারই সন্তান। পরে মর্ত্যে অবতাররূপে তার কাজ শেষ হলে রাম পুত্রদ্বয়ের হাতে শাসনভার ছেড়ে দিয়ে সরযূ নদীতে আত্মবিসর্জন করে বৈকুণ্ঠে ফিরে আসেন। মনে করা হয়, এই উত্তরকাণ্ড অংশটি পরবর্তীকালে বাল্মীকি রামায়ণের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।

ধর্মতাত্ত্বিক গুরুত্ব

রামায়ণ: পাঠ, চরিত্র, সংক্ষিপ্ত কাহিনী 
পূজাবেদীতে সীতা (ডানে), রাম (মধ্যে), লক্ষ্মণ (বামে) ও হনুমানের (নিচে বসে) মূর্তি; ভক্তিবেদান্ত ম্যানর, ওয়াটফোর্ড, ইংল্যান্ড

রামায়ণের নায়ক রাম হিন্দুধর্মে একজন অন্যতম প্রধান দেবতা বিবেচিত হন। রামায়ণ মহাকাব্যটিও কেবলমাত্র একটি মহৎ সাহিত্যিক নিদর্শনই নয়, বরং হিন্দুধর্মের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়। হিন্দু সংস্কার অনুযায়ী, রামায়ণ পাঠ অথবা শ্রবণে পাঠক বা শ্রোতা পাপমুক্ত হন।

হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, বিষ্ণু জগতের সকল জীবকে ধর্মের পথসন্ধান দিতে রাম রূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

আরিশা সাত্তারের মতে, রামায়ণ ও মহাভারতের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু হল রাম ও কৃষ্ণের গোপন দেবত্ব ও তার ক্রমপ্রকাশ।

রামায়ণের ভাষ্য

রামায়ণের প্রায় তেত্রিশটি ভাষ্য রয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়। রামায়ণের কতিপয় টীকা হলো মহেশ্বর তীর্থের তত্ত্বদ্বীপ বা তত্ত্বদীপিকা , গোবিন্দরাজের ভূষণ বা গোবিন্দরাজীয়ম্, শিবসহায়ের শিরোমণি, মহাদেব যোগীর অমৃতকটিয়ক, রামানুজের "রামানুজীয়ম্, অহোবলের " তানিশ্লোকি", নাগোজি ভট্ট ও রামবর্মার "তিলক" । রামায়ণের তিলক, ভূষণশিরোমণি নাম্নী তিনটি ভাষ্য ("টীকাত্রয় অথবা ভাষ্যত্রয়ী" নামেও পরিচিত) অধিক জনপ্রিয়।

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

তথ্যসূত্র

টীকা

অতিরিক্ত পঠন

    মূলগ্রন্থ (সংস্কৃত)
    অনুবাদ
  • Indian Odyssey by Martin Buckley (2008). The UK travel writer's journey in the footsteps of Ram contains an abridged modern version of the Ramayan.

বহিঃসংযোগ

অনুবাদ (ইংরেজি)

গবেষণা নিবন্ধ

Tags:

রামায়ণ পাঠরামায়ণ চরিত্ররামায়ণ সংক্ষিপ্ত কাহিনীরামায়ণ ধর্মতাত্ত্বিক গুরুত্বরামায়ণ ের ভাষ্যরামায়ণ আরও দেখুনরামায়ণ তথ্যসূত্ররামায়ণ তথ্যসূত্ররামায়ণ টীকারামায়ণ অতিরিক্ত পঠনরামায়ণ বহিঃসংযোগরামায়ণবাল্মীকিভারতীয় মহাকাব্যমহাভারতসংস্কৃতস্মৃতি (হিন্দুশাস্ত্র)হিন্দুশাস্ত্র

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

অমর্ত্য সেনজাহ্নবী কাপুরমোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনএশিয়ার সার্বভৌম রাষ্ট্র ও নির্ভরশীল অঞ্চলসমূহের তালিকাউমাইয়া খিলাফতপ্রথম বিশ্বযুদ্ধরাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়রজনীকান্ত সেনবাংলাদেশের উপজেলার তালিকাহিন্দুধর্মের ইতিহাসপ্রীতি জিনতাসার্বিয়াগোপাল ভাঁড়হেইনরিখ ক্লাসেনঅশোকসূরা নাসপদ্মা সেতু২০২৪মুজিবনগরক্যাটরিনা কাইফবৈসাবি উৎসবসহীহ বুখারীরাজনীতিরোমান্টিকতাসিঙ্গাপুরগর্ভধারণঠাকুর অনুকূলচন্দ্রঅ্যান্টিবায়োটিক তালিকাবিজয় এক্সপ্রেসগাঁজা (মাদক)বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজসমূহের তালিকাইব্রাহিম রাইসিঈদ মোবারকআসামগাজাসৌদি রিয়ালবিরাট কোহলিতাজবিদশিয়া ইসলামচট্টগ্রামরচনা বন্দ্যোপাধ্যায়জগদীশ চন্দ্র বসুবাউল সঙ্গীতইসরায়েল–হামাস যুদ্ধব্যাংকচিরস্থায়ী বন্দোবস্তমানব দেহসূরা ফাতিহাআব্বাসীয় খিলাফতবেলি ফুলফিতরাদুর্গাপূজাজয়া আহসানমুসাবাংলাদেশের প্রশাসনিক অঞ্চলসূরা ফালাকখাজা সলিমুল্লাহআওরঙ্গজেবমুহাম্মাদরামকৃষ্ণ পরমহংসবাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ের মধ্যকার একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচের তালিকাওয়াহাবি আন্দোলন১ (সংখ্যা)বিড়ালভৌগোলিক আয়তন অনুযায়ী সার্বভৌম রাষ্ট্র ও নির্ভরশীল অঞ্চলসমূহের তালিকাবাংলা সাহিত্যভারতীয় জনতা পার্টিরক্তের গ্রুপশওকত আলী ইমনমিজানুর রহমান আজহারীভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসশিয়া ইসলামের ইতিহাসশব্দ (ব্যাকরণ)সৌদি আরবের ইতিহাসক্ষুদিরাম বসুময়মনসিংহ জেলাইতিহাসমহাত্মা গান্ধী🡆 More