মানব মস্তিষ্ক মানব স্নায়ুতন্ত্রের কেন্দ্রীয় অঙ্গ । এটি সুষুম্নাকাণ্ডের সাথে মিলে মানবদেহের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র গঠন করেছে। মানুষের মস্তিষ্ক গুরুমস্তিষ্ক, মস্তিষ্ককাণ্ড ও লঘুমস্তিষ্ক নামক তিনটি অংশ নিয়ে গঠিত। মস্তিষ্ক মানবদেহের সিংহভাগ কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এই উদ্দেশ্যে মস্তিষ্ক সংজ্ঞাবহ স্নায়ুতন্ত্র বা জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলি থেকে তথ্য সংগ্রহ করে, সেগুলির প্রক্রিয়াজাতকরণ সম্পন্ন করে, প্রক্রিয়াজাত তথ্যগুলির সমবায় ও সমন্বয় সাধন করে এবং এর প্রত্যুত্তরে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ বা তন্ত্রে স্নায়ুকেন্দ্র থেকে কী ধরনের নির্দেশাবলি স্নায়বিক সমন্বয়যুক্ত অঙ্গে বা তন্ত্রে পাঠানো হবে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। নরম উপাদানে গঠিত মস্তিষ্ক মানুষের মাথাতে (মানবমস্তক) খুলির হাড়গুলির ভেতরে সুরক্ষিত অবস্থায় থাকে।
মানব মস্তিষ্ক | |
---|---|
বিস্তারিত | |
পূর্বভ্রূণ | স্নায়ু নালিকা |
তন্ত্র | কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র স্নায়ু অনাক্রম্যতন্ত্র |
ধমনী | অভ্যন্তরীণ চেতন ধমনীসমূহ, মেরুদণ্ডীয় ধমনীসমূহ |
শিরা | অভ্যন্তরীণ গ্রীবা শিরা, অভ্যন্তরীণ মস্তিষ্ক শিরাসমূহ, বহিঃশিরাসমূহ: (ঊর্ধ্ব ও অধোমস্তিষ্ক শিরাসমূহ, মধ্য মস্তিষ্ক শিরাসমূহ), মস্তিষ্কতলীয় শিরা, ঊর্ধ্ব থ্যালামাস-ডোরাকাটা শিরা, আবরণীবৎ শিরা, লঘুমস্তিষ্ক শিরাসমূহ |
শনাক্তকারী | |
লাতিন | Cerebrum কেরেব্রুম (ইংরেজি উচ্চারণ সেরিব্রাম) |
গ্রিক | ἐγκέφαλος (enképhalos) এনকেফালোস |
টিএ৯৮ | A14.1.03.001 |
টিএ২ | 5415 |
এফএমএ | FMA:50801 |
শারীরস্থান পরিভাষা |
গুরুমস্তিষ্ক মানব মস্তিষ্কের বৃহত্তম অংশ। এটি দুইটি মস্তিষ্ক গোলার্ধে বিভক্ত। গুরুমস্তিষ্কের বহিঃস্তর ধূসর পদার্থ দিয়ে গঠিত এবং এটি শ্বেত পদার্থ দিয়ে গঠিত একটি মজ্জাকে ঘিরে রেখেছে। বহিঃস্তরটিকে নবমস্তিষ্ক বহিঃস্তর এবং অপেক্ষাকৃত অনেক ছোট আদিমস্তিষ্ক বহিঃস্তর – এই দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়। নবমস্তিষ্ক বহিঃস্তরটি ছয়টি স্নায়ুকোষীয় স্তর নিয়ে গঠিত, অন্যদিকে আদিমস্তিষ্ক বহিঃস্তরটিতে তিন বা চারটি স্তর থাকে। প্রতিটি মস্তিষ্ক গোলার্ধকে চিরায়তভাবে চারটি খণ্ডকে ভাগ করা হয় – ললাটীয় খণ্ডক, রগাঞ্চলীয় খণ্ডক, পার্শ্বকরোটি খণ্ডক এবং পশ্চাৎকরোটি খণ্ডক। ললাটীয় খণ্ডকটি নির্বাহী কার্যকলাপ যেমন আত্ম-নিয়ন্ত্রণ, পরিকল্পনা, যুক্তিপাত ও বিমূর্ত চিন্তার সাথে সংশ্লিষ্ট। অন্যদিকে পশ্চাৎকরোটি খণ্ডকটি বীক্ষণের (অর্থাৎ দর্শন বা দেখা) কাজে নিয়োজিত। বহিঃস্তরীয় প্রতিটি খণ্ডকে বিভিন্ন এলাকা থাকে যেগুলি বিশেষ বিশেষ কাজের সাথে সম্পর্কিত। যেমন সংবেদী বহিঃস্তর, চেষ্টীয় বহিঃস্তর এবং সংযুক্তি অঞ্চলসমূহ। যদিও ডান ও বাম মস্তিষ্ক গোলার্ধগুলি আকৃতি ও কাজে মোটামুটি একই রকম, কিছু কিছু কাজ একটি মাত্র গোলার্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট, যাকে মস্তিষ্ককার্যের পার্শ্বীভবন বলে। যেমন ভাষা বাম মস্তিষ্ক এবং স্থানিক দৃষ্টিক্ষমতা ডান মস্তিষ্কের সাথে সম্পর্কিত। গোলার্ধগুলি করোটিসন্ধি তন্তু দ্বারা একে অপরের সাথে সংযুক্ত থাকে; এদের মধ্যে বৃহত্তমটিকে গুরুমস্তিষ্ক যোজক বলে।
গুরুমস্তিষ্ক মস্তিষ্ককাণ্ডের মাধ্যমে সুষুম্নাকাণ্ডের সাথে সংযুক্ত থাকে। মস্তিষ্ককাণ্ডটি মধ্যমস্তিষ্ক, লঘুমস্তিষ্ক যোজক এবং সুষুম্নাশীর্ষক নিয়ে গঠিত। লঘুমস্তিষ্ক মস্তিষ্ককাণ্ডের সাথে একজোড়া লঘুমস্তিষ্ক বৃন্তদন্তের মাধ্যমে যুক্ত থাকে। গুরুমস্তিষ্কের ভেতরে মস্তিষ্কগহ্বর ব্যবস্থা অবস্থিত, যাতে চারটি পরস্পর-সংযুক্ত মস্তিষ্কগহ্বর থাকে। এই গহ্বরগুলির ভেতরে মস্তিষ্ক-সুষুম্না তরল উৎপাদিত হয় ও চলাচল করে। গুরুমস্তিষ্ক বহিঃস্তরের নিচে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো বা অঙ্গ অবস্থিত, যাদের মধ্যে (আন্তরমস্তিষ্ক) কক্ষ (থ্যালামাস), অধিকক্ষ (এপিথ্যালামাস), অবকক্ষ (হাইপোথ্যালামাস), অধোকক্ষ (সাবথ্যালামাস), পিনিয়াল গ্রন্থি ও পিটুইটারি গ্রন্থি উল্লেখযোগ্য। আরও আছে প্রান্তীয় কাঠামোসমূহ, যাদের মধ্যে বাদামাকৃতি কেন্দ্র (অ্যামিগডালা) ও সমুদ্রঘোড়াকৃতি কেন্দ্র (হিপোক্যাম্পাস); বেষ্টকেন্দ্র (ক্লস্ট্রাম), মস্তিষ্কতলীয় স্নায়ুগ্রন্থিগুলির বিভিন্ন কোষকেন্দ্র; সম্মুখমস্তিষ্কতলীয় কাঠামোসমূহ এবং তিনটি গহ্বরবেষ্টনকারী অঙ্গ। মস্তিষ্কের কোষগুলির মধ্যে আছে স্নায়ুকোষ (নিউরন) এবং এগুলিকে সমর্থনকারী স্নায়ুধারকোষ (গ্লিয়া কোষ)। মানব মস্তিষ্কে ৮ হাজার ৬ শত কোটিরও বেশি স্নায়ুকোষ আছে এবং একই সংখ্যক বা তারও বেশি সংখ্যক অন্যান্য কোষ আছে। স্নায়ুকোষগুলি একে অপরের সাথে সংযুক্ত থাকে এবং স্নায়বিক উদ্দীপনার প্রত্যুত্তরে স্নায়ুপ্রেরক নামের পদার্থ নিঃসরণ করে, ফলে মস্তিষ্ক তার কার্যাবলি সম্পাদন করতে পারে। স্নায়ুকোষগুলি স্নায়ুপথ ও বর্তনীর সমন্বয়ে একটি বিস্তৃত স্নায়বিক জালিকাব্যবস্থা গঠন করে। এই পুরো বর্তনীব্যবস্থাটি স্নায়ুপ্রেরণ প্রক্রিয়ার দ্বারা চালিত হয়।
মস্তিষ্ককে মাথার খুলি সুরক্ষা প্রদান করে। এটি মস্তিষ্ক-সুষুম্না তরলের মধ্যে নিমজ্জিত থাকে। এটি রক্ত-মস্তিষ্ক প্রতিবন্ধকের দ্বারা রক্ত সংবহন তন্ত্র থেকে পৃথক থাকে। তা সত্ত্বেও মস্তিষ্কের ক্ষতি, রোগব্যাধি বা জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। মাথায় চোট লেগে বা সন্ন্যাসরোগ (হঠাৎ রক্তের সরবরাহ বন্ধ হওয়া তথা “স্ট্রোক” হওয়া) হয়ে মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে পারে। এছাড়া মস্তিষ্কে পার্কিনসনের রোগ, চিত্তভ্রংশ যেমন আলৎসহাইমারের রোগ এবং বহুল কঠিনীভবন (মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস) জাতীয় অবক্ষয়মূলক ব্যাধি হতে পারে। কিছু মানসিক ব্যাধি, যেমন চিত্তভ্রংশী বাতুলতা এবং গুরুতর বিষন্নতাজনিত ব্যাধি মস্তিষ্কের কার্যবিকৃতির সাথে সম্পর্কিত বলে ধারণা করা হয়। এর বাইরে মস্তিষ্কে নির্দোষ ও সংহারক উভয় ধরনের অর্বুদ (টিউমার) হতে পারে। সংহারক বা প্রাণঘাতী অর্বুদগুলি সাধারণত মানবদেহের অন্যান্য স্থান থেকে উৎপত্তি লাভ করে।
মানব পুরুষ ও নারীর মস্তিস্কের মধ্যে গঠনগত পার্থক্য দেখা যায়। নারীর ললাটীয় খণ্ডক ও প্রান্তীয় মস্তিষ্ক-বহিঃস্তর (লিম্বিক কর্টেক্স) পুরুষদের তুলনায় বড় হয়। মস্তিস্কের ললাটীয় এই দুইটি অংশ সমস্যা সমাধান ও আবেগ নিয়ন্ত্রণের সাথে জড়িত। অন্যদিকে পুরুষদের মস্তিষ্কের পার্শ্বকরোটীয় মস্তিষ্ক-বহিঃস্তর ও বাদামাকৃতি কেন্দ্র (অ্যামিগডালা) নারীদের তুলনায় বড় হয়ে থাকে। এই অংশ দুইটি স্থানিক ধারণা তৈরি ও স্মৃতি প্রক্রিয়াজাত করার সাথে জড়িত।
মস্তিষ্কের শারীরস্থান বিষয়ক গবেষণাক্ষেত্রকে স্নায়ুশারীরস্থানবিজ্ঞান বলে। অন্যদিকে মস্তিষ্কের কার্যকলাপের গবেষণাকে স্নায়ুবিজ্ঞান বলে। মস্তিষ্ককে অধ্যয়ন করার জন্য বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন করা হয়। ঐতিহ্যগতভাবে অন্যান্য প্রাণীর জৈব নমুনায় প্রাপ্ত কলা ও কোষগুলি অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করে অনেক তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে চিকিৎসাবৈজ্ঞানিক চিত্রণ প্রযুক্তি যেমন বৃত্তিমূলক স্নায়ুচিত্রণ এবং বৈদ্যুতিক মস্তিষ্কলেখচিত্র ধারণ মস্তিষ্কের অধ্যয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এছাড়া মস্তিকে আঘাতপ্রাপ্ত রোগীদের চিকিৎসা ইতিহাস অধ্যয়ন করে মস্তিষ্কের প্রতিটি অংশের কাজ বা বৃত্তি সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি লাভ করা সম্ভব হয়েছে।
বৈজ্ঞানিক সমাজের বাইরের সংস্কৃতিতে মনের দর্শন নামের গবেষণাক্ষেত্রটিতে বহু শতাব্দী ধরে চেতনার প্রকৃতি ও মন-দেহ সমস্যার মত প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজার প্রচেষ্টা চলছে। ১৯শ শতকের শেষদিকে বহিঃমস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চল ও মানুষের ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন ধর্ম সংযুক্ত করার একটি ছদ্মবিজ্ঞান প্রচলিত ছিল।
This article uses material from the Wikipedia বাংলা article মানব মস্তিষ্ক, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.