১৯০৫ বঙ্গভঙ্গ

বঙ্গভঙ্গ বাংলার ইতিহাসে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জনের আদেশে ১ম বঙ্গভঙ্গ সম্পন্ন হয়। বাংলা বিভক্ত করে ফেলার ধারনাটি অবশ্য কার্জন থেকে শুরু হয়নি। ১৭৬৫ সালের পর থেকেই বিহার ও ওড়িশা বাংলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে সরকারী প্রশাসনিক এলাকা হিসেবে বাংলা অতিরিক্ত বড় হয়ে যায় এবং ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে এটির সুষ্ঠু শাসনক্রিয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। বঙ্গভঙ্গের সূত্রপাত এখান থেকেই।

১৯০৫ বঙ্গভঙ্গ
পূর্ব বঙ্গ ও আসাম প্রদেশের মানচিত্র

কিন্তু ১৯১১ সালে, প্রচণ্ড গণআন্দোলনের ফলশ্রুতিতে বঙ্গভঙ্গ রহিত হয়। দ্বিতীয়বার বঙ্গভঙ্গ হয় ১৯৪৭ সালে। এর ফলে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানে এবং পশ্চিমবঙ্গ ভারতে যুক্ত হয়। এই পূর্ববঙ্গই পরবর্তীকালে পাকিস্তানের কাছ থেকে এক রক্তক্ষয়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে ও বাংলাদেশ নামক একটি নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে।

পটভূমি

বঙ্গ প্রদেশের আয়তন ছিল ১,৮৯,০০০ বর্গমাইল (৪,৯০,০০০ কিমি) এবং জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৮৫ লাখ। বঙ্গের পূর্বাঞ্চল ভৌগোলিক এবং অপ্রতুল যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে পশ্চিমাঞ্চল হতে প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল। ১৮৩৬ সালে উত্তরাঞ্চলের প্রদেশগুলোকে বঙ্গ থেকে পৃথক করে একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধিনে ন্যস্ত করা হয় এবং ১৮৫৪ সালে বঙ্গের প্রশাসনিক দায়িত্ব হতে গভর্নর-জেনারেল-ইন-কাউন্সিলকে অব্যাহতি দিয়ে একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের উপর অর্পণ করা হয়। ১৮৭৪ সালে সিলেট সহ আসামকে বঙ্গ হতে বিচ্ছিন্ন করে চিফ-কমিশনারশীপ গঠন করা হয় এবং ১৮৯৮ সালে লুসাই পাহাড়কে এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়।

বিভক্তিকরণ

১৯০৩ সালে প্রথম বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবসমূহ বিবেচনা করা হয়। তখন বঙ্গ হতে চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করা এবং ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাদ্বয়কে আসাম প্রদেশে অন্তর্ভুক্ত করার একটি প্রস্তাবও ছিল। তেমনিভাবে ছোট নাগপুরকে মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে আত্তিকরণেরও একটি প্রস্তাব ছিল। ১৯০৪ সালের জানুয়ারিতে সরকারীভাবে এই পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয় এবং ফেব্রুয়ারিতে লর্ড কার্জন বঙ্গের পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে এক সরকারি সফরের মাধ্যমে এই বিভক্তির ব্যাপারে জনমত যাচাইয়ের চেষ্টা করেন। তিনি বিভিন্ন জেলার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে এই বিভক্তির বিষয়ে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বক্তৃতা দেন।

পার্বত্য ত্রিপুরা রাজ্য, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও রাজশাহী (দার্জিলিং বাদে) বিভাগ এবং মালদা জেলা, আসাম প্রদেশের সঙ্গে একীভূত হয়ে এই নতুন প্রদেশ গঠন করবে। এর ফলে বঙ্গ শুধু তার বৃহৎ পূর্বাঞ্চলই হারাবে না, তাকে হিন্দীভাষী পাঁচটি রাজ্যও মধ্যপ্রদেশকে ছেড়ে দিতে হবে। অন্যদিকে পশ্চিমে সম্বলপুর এবং মধ্যপ্রদেশের পাঁচটি ওড়িয়া-ভাষী রাজ্যের সামান্য অংশ বঙ্গকে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। ফলে বঙ্গের আয়তন দাঁড়ায় ১,৪১,৫৮০ বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা ৫ কোটি ৪০ লাখ, যার মধ্যে ৪ কোটি ২০ লাখ হিন্দু ও ৯০ লাখ মুসলিম।

নতুন প্রদেশটির নামকরণ করা হয় “পূর্ব বঙ্গ ও আসাম” যার রাজধানী হবে ঢাকা এবং অনুষঙ্গী সদর দফতর হবে চট্টগ্রাম। এর আয়তন হবে ১,০৬,৫০৪ বর্গমাইল (২,৭৫,৮৪০ কিমি) এবং জনসংখ্যা হবে ৩ কোটি ১০ লাখ, যাদের মধ্যে ১ কোটি ৮০ লাখ মুসলিম ও ১ কোটি ২০ লাখ হিন্দু। এর প্রশাসন একটি আইন পরিষদ ও দুই সদস্যবিশিষ্ট একটি রাজস্ব বোর্ড নিয়ে গঠিত হবে এবং কলকাতা হাইকোর্টের এখতিয়ার বজায় থাকবে। সরকার নির্দেশ দেয় যে পূর্ব বঙ্গ ও আসামের পশ্চিম সীমানা স্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট থাকবে সাথে সাথে এর ভৌগোলিক, জাতিক, ভাষিক ও সামাজিক বৈশিষ্টাবলিও নির্দিষ্ট থাকবে। সরকার তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ১৯শে জুলাই, ১৯০৫ সালে এবং বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয় একই বছরের ১৬ই অক্টোবর।

নবগঠিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ

বিভাগ ও নাম অন্তর্ভুক্ত জেলাসমূহ
ঢাকা (রাজধানী) ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ ও সুন্দরবন।
চট্টগ্রাম চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা, কুমিল্লা।
রাজশাহী রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, পাবনা, মালদহ ও জলপাইগুড়ি।
সুরমা উপত্যকা ও পার্বত্য বিভাগ সিলেট, কাছাড়, লুসাই পার্বত্য জেলা, নাগা পার্বত্য জেলা, খাসিয়া জয়ন্তিয়া পার্বত্য জেলা ও গারো পার্বত্য জেলা।
আসাম উপত্যকা গোয়ালপাড়া, কামরূপ, দাররাং, নওগাও, শিবসাগর ও লখিমপুর জেলা।
দেশীয় রাজ্য পার্বত্য ত্রিপুরা ও মনিপুর।

বঙ্গভঙ্গ রদ

এই ঘটনা এক প্রচণ্ড রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। পূর্ব বঙ্গের মুসলিমদের এই ধারণা হয় যে নতুন প্রদেশের ফলে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ বেড়ে যাবে। যদিও পশ্চিমবঙ্গের জনগণ এই বিভক্তি মেনে নিতে পারল না এবং প্রচুর পরিমাণে জাতীয়তাবাদী লেখা এই সময় প্রকাশিত হয়। ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গ রদ করার প্রস্তাবকদের জন্য এক মর্মস্পর্শী গান আমার সোনার বাংলা লেখেন, যা অনেক পরে, ১৯৭২ সালে, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতে পরিণত হয়।

এই সকল রাজনৈতিক প্রতিবাদের ফলশ্রুতিতে ১৯১১ সালে বঙ্গ আবার একত্রিত হয়। ভাষাতাত্ত্বিক এক নতুন বিভক্তির মাধ্যমে হিন্দি, ওড়িয়া এবং অসমীয়া অঞ্চলগুলো বঙ্গ হতে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় আনা হয়। এরই সাথে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে নয়া দিল্লীতে স্থানান্তর করা হয়।

প্রভাব

১৯০৫ সালের রাজনৈতিক ধাক্কায় বিশেষভাবে পূর্ববঙ্গ জেগে উঠে এবং ব্যস্ত হয়ে পড়ে মাধ্যমিক শিক্ষার সম্প্রসারনে। পরবর্তী পাঁচ বছরে এই এলাকায় মাধ্যমিক বিদ্যালয় বৃদ্ধির শতকরা হার দাঁড়িয়েছিলো ৮২.৯ ভাগ।

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

Tags:

১৯০৫ বঙ্গভঙ্গ পটভূমি১৯০৫ বঙ্গভঙ্গ বিভক্তিকরণ১৯০৫ বঙ্গভঙ্গ নবগঠিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ১৯০৫ বঙ্গভঙ্গ বঙ্গভঙ্গ রদ১৯০৫ বঙ্গভঙ্গ প্রভাব১৯০৫ বঙ্গভঙ্গ আরও দেখুন১৯০৫ বঙ্গভঙ্গ তথ্যসূত্র১৯০৫ বঙ্গভঙ্গ বহিঃসংযোগ১৯০৫ বঙ্গভঙ্গওড়িশাবিহারভারতের ভাইসরয়লর্ড কার্জন১৭৬৫

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

নারায়ণগঞ্জ জেলাবাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সরঞ্জামের তালিকাকমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনএকতা এক্সপ্রেসরক্তএপ্রিলবাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিদের তালিকাজলদস্যুতাও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদকলাবাংলাদেশ বিমান বাহিনীখালিদ বিন ওয়ালিদমহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রব্যবস্থাপনাচিলমারীর অষ্টমীর স্নান ও মেলাইসলাম ও হস্তমৈথুনখাজা সলিমুল্লাহরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরশবনম বুবলিমেটা প্ল্যাটফর্মসভাইরাসবাংলাদেশের জাতীয় পতাকাচট্টগ্রামফিতরাজর্ডানের ধর্মপ্রধান পাতাঅস্ট্রেলিয়াকবিতালালনভারতের জাতীয় পতাকামহাদেশজামালপুর জেলাজাতিসংঘের মহাসচিবশব্দ (ব্যাকরণ)আফগানিস্তানসাইবার অপরাধময়মনসিংহ জেলাবর্ষবরণবিশ্ব দিবস তালিকাভারতের সংবিধানওঁদ্বাদশ জাতীয় সংসদ সদস্যদের তালিকাষাট গম্বুজ মসজিদবুর্জ খলিফাবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়টাইটানিকসৌদি রিয়ালনিউটনের গতিসূত্রসমূহজালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমিস্বামী বিবেকানন্দকুমিল্লাত্রিপুরাইসরায়েলের ভূগোলক্রিস্তিয়ানো রোনালদোতুলসীবটআয়রন ডোমবাংলাদেশ ব্যাংকবাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকাগাজওয়াতুল হিন্দবাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরবাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলবাংলা স্বরবর্ণরাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়বাংলাদেশের বিমানবন্দরের তালিকাযৌন অসামঞ্জস্যতাছারপোকাপারমাণবিক অস্ত্রবাংলাদেশের জাতীয় প্রতীকবৈশাখবাংলাদেশের সংবিধানআরবি ভাষারূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানী লিমিটেডক্যামেরাবিকাশউজবেকিস্তানমার্ক জাকারবার্গঈদুল আযহাপশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা🡆 More