চড়ক পূজা পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকোৎসব। বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী, প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তিতে বা চৈত্রের শেষ দিনে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয় এবং বৈশাখের প্রথম দু-তিন দিনব্যাপী চড়ক পূজার উৎসব চলে। এটি চৈত্র মাসে পালিত হিন্দু দেবতা শিবের গাজন উৎসবের একটি অঙ্গ। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে যা চড়ক সংক্রান্তির মেলা নামে অভিহিত।
চড়ক পূজা | |
---|---|
অন্য নাম | নীল পূজা, গম্ভীরা পূজা, শিবের গাজন, হাজরহা পূজা, হরব |
পালনকারী | হিন্দু |
ধরন | হিন্দু |
লিঙ্গপুরাণ, বৃহদ্ধর্মপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে চৈত্র মাসে শিবারাধনা প্রসঙ্গে নৃত্যগীতাদি উৎসবের উল্লেখ থাকলেও চড়ক পূজার উল্লেখ নেই। পূর্ণ পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত গোবিন্দানন্দের বর্ষক্রিয়াকৌমুদী ও রঘুনন্দনের তিথিতত্ত্বেও এ পূজার উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে পাশুপত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনকালে এ উৎসব প্রচলিত ছিল। উচ্চ স্তরের লোকদের মধ্যে এ অনুষ্ঠানের প্রচলন খুব প্রাচীন নয়। জনশ্রতি রয়েছে, ১৪৮৫ খ্রিষ্টাব্দে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামের এক রাজা এই পূজা প্রথম শুরু করেন।
কথিত আছে, এই দিনে শিব-উপাসক বাণরাজা দ্বারকাধীশ কৃষ্ণের সংগে যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে মহাদেবের প্রীতি উৎপাদন করে আকাঙ্ক্ষায় ভক্তিসূচক নৃত্যগীতাদি ও নিজ গাত্ররক্ত দ্বারা শিবকে তুষ্ট করে অভীষ্ট সিদ্ধ করেন। সেই স্মৃতিতে শৈব সম্প্রদায় এই দিনে শিবপ্রীতির জন্য উৎসব করে থাকেন।
গম্ভীরাপূজা বা শিবের গাজন এই চড়কপূজারই রকমফের। চড়ক পূজা চৈত্রসংক্রান্তিতে অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিবসে পালিত হয়। এ পূজার বিশেষ অঙ্গের নাম নীলপূজা। পূজার আগের দিন চড়ক গাছটিকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয়। এতে জলভরা একটি পাত্রে শিবের প্রতীক শিবলিঙ্গ বা সিঁদুরমথিত লম্বা কাঠের তক্তা ('শিবের পাটা') রাখা হয়, যা পূজারিদের কাছে "বুড়োশিব" নামে পরিচিত। পতিত ব্রাহ্মণ এ পূজার পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন। পূজার বিশেষ বিশেষ অঙ্গ হলো কুমিরের পূজা, জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুঁড়ির ওপর লাফানো, বাণফোঁড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, চড়কগাছে দোলা এবং দানো-বারনো বা হাজরা পূজা করা।
এই সব পূজার মূলে রয়েছে ভূতপ্রেত ও পুনর্জন্মবাদের ওপর বিশ্বাস। এর বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রাচীন কৌমসমাজে প্রচলিত নরবলির অনুরূপ। পূজার উৎসবে বহু প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়। চড়কগাছে ভক্ত্যা বা সন্ন্যাসীকে লোহার হুড়কা দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়। তার পিঠে, হাতে, পায়ে, জিহ্বায় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে বাণ শলাকা বিদ্ধ করা হয়। কখনো কখনো জ্বলন্ত লোহার শলাকা তার গায়ে ফুঁড়ে দেয়া হয়। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার আইন করে এ নিয়ম বন্ধ করলেও গ্রামের সাধারণ লোকের মধ্যে এখনো তা প্রচলিত আছে।
পূজার উদ্যোক্তা ভক্ত্যা বা সন্ন্যাসীরা চড়ক পূজার কয়েকদিন আগে থেকে কঠোর ব্রত ও সংযম পালন করেন। একজনকে সাজানো হয় হনুমানের মত লম্বা লেজ দিয়ে, তার মাথায় থাকে উজ্জ্বল লাল রঙের ফুল; স্থানবিশেষে রামায়ণ কাহিনির হনুমানের গন্ধমাদন পর্বত আনার দৃশ্য অভিনীত হয়, একে বলে 'গিরি সন্ন্যাস'। এরপর সন্ন্যাসীরা মহাসমারোহে আমগাছ থেকে একাধিক ফলসমেত একটি শাখা ভেঙে আনেন, এর নাম 'বাবর সন্ন্যাস'। চড়কপূজার আগের দিন নীলচণ্ডিকার পূজা হয় (যা মূলত নীলপূজা নামে পরিচিত), এদিন কয়েকজনের একটি দল সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। দলে থাকে একজন শিব ও দু'জন সখী। সখীদের পায়ে থাকে ঘুঙুর। তাদের সঙ্গে থাকে ঢোল-কাঁসরসহ বাদকদল। সখীরা গান ও বাজনার তালে তালে নাচে। এদেরকে দেল বা নীল পাগলের দল'ও বলা হয়। এরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাজনের গান গায় এবং নাচ-গান পরিবেশন করে। বিনিময়ে দান হিসেবে যা কিছু পাওয়া যায় তা দিয়ে হয় পূজা। এদিন রাতে 'হাজরা পূজা' হয় এবং শিবের উদ্দেশ্যে খিচুড়ি ও শোলমাছ নিবেদিত হয়। মাঝরাতে শিবের আরাধনার সময়ে দু'একজন সন্ন্যাসী প্রবলবেগে মাথা ঘুরিয়ে মন্ত্র বলতে বলতে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন; এই অবস্থাকে দেবতার 'ভর' বলা হয়। এসময় তারা দর্শকমণ্ডলীর প্রশ্নের যা যা উত্তর দেয় তা অভ্রান্ত বলে সাধারণ বিশ্বাস করে।
চড়কের দিন সন্ন্যাসীরা বিশেষ বিশেষ ফল, ফুল নিয়ে বাদ্য সহকারে নানা ভঙ্গিমায় শিবপ্রণাম করে। এছাড়া, দেবতার অবিচল ভক্তি ও নিষ্ঠা প্রদর্শনের জন্য তারা ধারালো বঁটি, গাছের কাঁটার উপর ঝাঁপ দেন কিংবা পা'দুটি উপরে মাথা নিচের দিকে রেখে ঝুলে থাকেন। এগুলি যথাক্রমে 'বঁটি-ঝাঁপ', 'কাঁটা-ঝাপ' ও 'ঝুল-ঝাঁপ' নামে পরিচিত। আরো আত্মনির্যাতনের জন্য আড়াই থেকে চার-পাঁচ ইঞ্চি লম্বা একটি লৌহশলাকা সারাদিন জিভে বিদ্ধ করে রেখে সন্ধ্যার আগে পুকুরে গিয়ে সেটি খুলে ফেলে দেওয়া হয়, এর নাম 'বাণ-সন্ন্যাস'। পিঠের দুদিকে চামড়া ভেদ করে একটি সরু বেত প্রবেশ করিয়ে দেওয়াকে বলে 'বেত্র-সন্ন্যাস'। আর চড়ক গাছটি চড়কতলায় প্রোথিত করে তার মাথায় আরেকটি কাষ্ঠখণ্ড মধ্যস্থলে ছিদ্র করে স্থাপন করা হয়, যাতে চড়কগাছকে কেন্দ্র করে কাষ্ঠখণ্ডটি শূন্যে বৃত্তাকারে ঘুরতে পারে। এর একপ্রান্তের ঝোলানো দড়িতে একজন সন্ন্যাসী (আগেকার সময়ে সন্ন্যাসীরা পিঠের চামড়া ভেদ করে শিরদাঁড়াতে বঁড়শির মত বাঁকানো একটি লোহার কাঁটা গেঁথে ঝুলে থাকতেন) কোমরে গামছা বা কাপড় বেঁধে ঝুলে থাকেন, অপরপ্রান্তে কাষ্ঠখণ্ডটিকে চক্রাকারে চরকির মত ঘোরানো হয়; এই প্রক্রিয়াটির নাম 'বড়শি সন্ন্যাস'।
চড়ক পূজায় বিশেষ বৈশিষ্ট ভক্তের পিঠে লোহার হূক (বরশি) লাগিয়ে গাছে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। হুক লাগানো অবস্থায় ঘুরতে থাকে ভক্ত। ঘোরা শেষ হলে রক্ত বা কাটা চিহ্ন মিলয়ে যায়। অন্তজ সম্প্রদায়ভুক্তদের একটি বড় ধর্মীয় উৎসব হিসেবে এই পূজা ও মেলা বিবেচিত হয়ে আসছে। এই বিশেষ দিনে চড়কপূজা অনুষ্ঠিত হলেও এর প্রস্তুতি চলে টানা পনের দিন। শিব পার্বতীর পালা গেয়ে আয়োজকরা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়। চাল-ডাল, টাকা-পয়সা, মাগন (ভিক্ষা ) তুলে পূজার খরচ জোগাড় করে। চড়ক পূজাকে ঘিরে এই উৎসব উপভোগে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অগণিত শিশু ও নারী পুরুষের সমাগম ঘটে। শিব-পার্বতীর (হর-গৌরী) পালা উৎসব অন্তজ শ্রেণির মধ্যে দেখা গেলেও এটি আবহমান বাংলার একটি পরিচিতি উৎসব।
ভারতের মহারাষ্ট্রের বগাড় উৎসব, সিকিম-ভূটানের 'চোড়গ', শ্রীলংকার 'টুককুম' অন্ধ্রপ্রদেশের সিরিমনু উৎসব কিংবা মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত প্রাচীন ড্যান্সা ডে লো ভোলাডোরস্ উৎসব বাংলার গাজন উৎসবের চড়ক পূজার অনুরূপ। উক্ত উৎসব বা অনুষ্ঠানগুলিতেও পবিত্র (পূজিত) গাছে ভক্ত বা অনুষ্ঠানকারীকে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়।
This article uses material from the Wikipedia বাংলা article চড়ক পূজা, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.