আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলের ইতিহাস

আর্জেন্টিনায় ফুটবল খেলা শুরু হয় ১৮৬৭ সালে, তবে আর্জেন্টিনার প্রথম জাতীয় ফুটবল দল গঠিত হয় ১৯০১ সালে। তারা উরুগুয়ের বিপক্ষে একটি প্রীতি খেলায় প্রথম মুখোমুখি হয় যা অনুষ্ঠিত হয় ১৯০১ সালের ১৬ মে; যেখানে আর্জেন্টিনা ৩–২ ব্যবধানে জয় লাভ করে। এটি ছিল আর্জেন্টিনার প্রথম রেকর্ডকৃত ম্যাচ। অন্যান্য শিরোপার মধ্যে, তারা তিনবার ফিফা বিশ্বকাপ জিতেছে ১৯৭৮, ১৯৮৬ এবং ২০২২ সালে এবং ১৫ বার দক্ষিণ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছে।

ইতিহাস

প্রাথমিক ইতিহাস

আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলের ইতিহাস 
১৯০২ সালে উরুগুয়ের বিপক্ষে খেলার পূর্বে আর্জেন্টিনা দল। এটি জাতীয় দলের নথিভূক্ত প্রথম ছবি।

আর্জেন্টিনার নথিভুক্ত প্রথম খেলা ছিলো উরুগুয়ের বিরুদ্ধে। এই খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো মে ১৬, ১৯০১ সালে মোন্তেবিদেওতে এবং এতে আর্জেন্টিনা ৩-২ ব্যবধানে জয় লাভ করে। প্রথম বছরে, প্রীতি খেলায় শুধুমাত্র দক্ষিণ আমেরিকান দলসমূহই বিরুদ্ধে ছিল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অন্যান্য দেশে ভ্রমণের অসুবিধার কারণে। সেই দলের সদস্য ছিলেন, আর ডব্লিউ রুদ, ডব্লিউ লেসলি, এ সি এ্যডিকট, এ এ ম্যাক, এইচ র‌্যাটক্লিফ, ই এল ডুগান, জি ই লেসলি, জে ও অ্যান্ডারসন (চ্যাপ্টার), এস ইউ লিওনার্ড, ই ডিকিনসন এবং জি এন ডিকিনসন। লোমাস অ্যাথলেটিক এবং অ্যালামনাইয়ে অধিকাংশ খেলোয়াড়ের সেই খেলার জন্য ডাক পড়ে, যাদের অনেকেই আর্জেন্টিনার ফুটবল অপেশাদার যুগের সর্বাধিক সফল দলের মধ্যে ছিল। দ্বিতীয় খেলায় একই মাঠে উরুগুয়ের বিপক্ষে ৬-০ ব্যবধানে আর্জেন্টিনা বৃহৎ বিজয় লাভ করে।

দীর্ঘ অণুপস্থিতি (১৯৩৪–১৯৫৪)

১৯৩৮ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তিনটি বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়। তবে বিভিন্ন কারণে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেনি। ১৯৩৮ ফিফা বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় ফ্রান্সে। টানা দ্বিতীয়বার ইউরোপে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবার ফলে এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয় আর্জেন্টিনা এবং উরুগুয়ে। প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয় ইতালি, যা ছিল তাদের দ্বিতীয় শিরোপা। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে কয়েক বছর বিশ্বকাপ বন্ধ ছিল। বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথম বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫০ সালে ব্রাজিলে। কিন্তু ব্রাজিলীয় ফুটবল সংস্থার সাথে দ্বন্দ্ব্বের কারণে এই বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেনি আর্জেন্টিনা। এরপর ১৯৫৪ সুইজারল্যান্ড বিশ্বকাপেও অংশগ্রহণ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে তারা। টানা তিনটি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ না করলেও এই সময়ের মধ্য আর্জেন্টিনা ১৯৩৭, ১৯৪১, ১৯৪৫, ১৯৪৬, ১৯৪৭, ১৯৫৫ ও ১৯৫৭ সালে দক্ষিণ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশীপের শিরোপা জেতে।

সুইডেন ডিজাস্টার – দ্রুত পরিবর্তন

২৪ বছর পর ১৯৫৮ সুইডেন বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করে আর্জেন্টিনা। ম্যাশিও, অ্যাঞ্জিলিলো এবং সিভরির মত খেলোয়াড়রা অণুপস্থিত থাকলেও, দলটি অ্যামাদিও ক্যারিজো, পেদ্রো দেলাচা, হোসে র‍্যামোস দেলগ্যাদো, অরেস্তে করবাতা, অ্যাঞ্জেল লাব্রুনা এবং হোসে স্যানফিলিপোর মত খেলোয়াড়দের নিয়ে গঠিত হয়েছিল। কিন্তু ইউরোপীয় দলগুলোর মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা কম থাকায় চরম দূর্ভোগ পোহাতে হয় তাদের। বিশ্বকাপে তাদের প্রথম খেলায় তারা পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ৩–১ ব্যবধানে পরাজিত হয়। দ্বিতীয় খেলায় উত্তর আয়ারল্যান্ডকে হারালেও, তৃতীয় খেলায় চেকস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে ৬–১ ব্যবধানে পরাজিত হয় তারা, যা ছিল বিশ্বকাপে কোন দলের সর্বোচ্চ ব্যবধানে পরাজয়। ফলে আর্জেন্টিনা প্রতিযোগিতা থেকে বাদ পড়ে যায়। বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার এই ঘটনা ‘‘এল দিজাস্ট্রে দি সুইসিয়া (দ্য সুইডেন ডিজাস্টার)’’ নামে পরিচিত। দলটি যখন বিশ্বকাপ থেকে ফিরে বুয়েনোস আইরেসে পৌছায়, তখন এজিজা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রায় ১০,০০০ মানুষ তাদেরকে অপমান করার আশায় ছিল।

সুইডেন ডিজাস্টারের পর আর্জেন্টিনা প্রথম অফিসিয়াল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ১৯৫৯ সালে, কোপা আমেরিকার নতুন সংস্করনে। তারা এই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়। এটি ছিল তাদের দ্বাদশ শিরোপা। তারা চিলিকে ৬–১ ব্যবধানে, বলিভিয়াকে ২–১ ব্যবধানে, পেরু ও প্যারাগুয়েকে ৩–১ ব্যবধানে, উরুগুয়েকে ৪–১ ব্যবধানে হারায় এবং ব্রাজিলের বিপক্ষে ১–১ গোলে ড্র করে প্রতিযোগিতায় অপরাজেয় হিসেবে শিরোপা জেতে। এরপর ১৯৯১ সাল পর্যন্ত আর কোন কোপা আমেরিকা শিরোপা জিততে পারেনি আর্জেন্টিনা।

১৯৬০ সালে আর্জেন্টিনা প্রথম প্যানআমেরিকান চ্যাম্পিয়নশীপ জেতে। ছয়টি খেলার চারটিতে জয় লাভ করে নয় পয়েন্ট নিয়ে এই শিরোপা জেতে তারা।

১৯৬২–১৯৭৪

১৯৬২ বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনার ভাল যায়নি। চিলিতে অনুষ্ঠিত এই বিশ্বকাপ ছিল ফিফা আয়োজিত ৭ম বিশ্বকাপ। প্রথম পর্বের প্রথম খেলায় বুলগেরিয়াকে ১–০ ব্যবধানে পরাজিত করে আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয় খেলায় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩–১ ব্যবধানে পরাজয় এবং শেষ খেলায় হাঙ্গেরির সাথে ড্র করায় প্রথম পর্বে তিন পয়েন্ট অর্জন করে তারা। অপরদিকে, ইংল্যান্ডও তিন পয়েন্ট অর্জন করে, কিন্তু গোল ব্যবধানে পিছিয়ে থাকায় প্রতিযোগিতা থেকে বিদায় নিতে হয় আর্জেন্টিনাকে।

১৯৬৩ সালে, কোপা আমেরিকায় আর্জেন্টিনা তৃতীয় স্থান অর্জন করে। প্রতিযোগিতায় তারা ব্রাজিল, ইকুয়েডর ও কলম্বিয়াকে হারালেও, বলিভিয়া এবং পেরুর বিপক্ষে পরাজিত হয়।

১৯৬৬ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা অংশগ্রহণ করে। প্রতিযোগিতার প্রথম পর্ব তারা অপরাজেয়ভাবে অতিক্রম করে। প্রথম খেলায় স্পেনকে ২–১ ব্যবধানে পরাজিত করে তারা। খেলায় আর্জেন্টিনার পক্ষে জোড়া গোল করেন লুইস আর্তাইম। দ্বিতীয় খেলায় পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র করে আর্জেন্টিনা। তৃতীয় খেলায়, সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে লুইস আর্তাইম ও এর্মিন্দো ওনেগার গোলে ২–০ ব্যবধানে জয় লাভ করে তারা। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১–০ ব্যবধানে হেরে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়ে আর্জেন্টিনা।

১৯৬৭ কোপা আমেরিকা আর্জেন্টিনা দূর্দান্তভাবে শুরু করে। ছয় খেলার পাঁচটিতেই তারা জয় লাভ করে এবং উরুগুয়ের বিপক্ষে পরাজিত হয়। প্রতিযোগিতায় তারা দ্বিতীয় হয়।

১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে চারবার দলের কোচ পরিবর্তন করে আর্জেন্টিনীয় ফুটবল সংস্থা। এই সময়ের মধ্যে আর্জেন্টিনা অনেকগুলো প্রীতি খেলায় অংশগ্রহণ করে। যার মধ্যে অধিকাংশই ছিল দক্ষিণ আমেরিকার দলগুলোর বিপক্ষে। এছাড়া এই সময়ে আর্জেন্টিনা লিপতন কাপ শিরোপাও জেতে।

১৯৬৯ সালে, আর্জেন্টিনা কোচ পেদেরনেরার অধীনে ১৯৭০ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু তারা বাছাইপর্ব টপকাতে সমর্থ হয়নি। আর্জেন্টিনার ফুটবলের ইতিহাসে এই প্রথম কোন বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব পার হতে অপারগ হয় তারা। ফলে পেদেরনেরাকে হটিয়ে কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয় হুয়ান হোসে পিজুতিকে। তিনি তিন বছর কোচের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় আর্জেন্টিনা দক্ষিণ আমেরিকার দলগুলোর বিপক্ষে কিছু প্রীতি খেলায় জয় লাভ করে, যার মধ্যে রয়েছে ১৯৭১ সালের রোকা কাপ শিরোপা। ১৯৭২ সালে, ব্রাজিল ইন্ডিপেনডেন্স কাপ খেলার জন্য আর্জেন্টিনাকে আমন্ত্রন জানানো হয়, কিন্তু সেখানে আর্জেন্টিনা ভাল ফলাফল অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। ইন্ডিপেনডেন্স কাপের পর পিজুতিকে সরিয়ে দলের কোচ হিসেবে ওমর সিভরিকে নিয়োগ দেয় আর্জেন্টিনীয় ফুটবল সংস্থা।

১৯৭৪ বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব শুরু হয় ১৯৭৩ সালে। বাছাইপর্ব সফলভাবে টকপাতে সমর্থ হয় আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপের মূলপর্বে স্থান করিয়ে দেওয়ার পর কোচের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি নেন সিভরি। মূলপর্বে পোল্যান্ড, ইতালি এবং হাইতির সাথে গ্রুপ ভাগাভাগি করে আর্জেন্টিনা। পোল্যান্ডের বিপক্ষে হার (৩–২), ইতালির বিপক্ষে ড্র (১–১) এবং হাইতির বিপক্ষে জয় লাভ (৪–১) করে দ্বিতীয় পর্বের টিকিট পায় তারা। দ্বিতীয় পর্বে গ্রুপ এ থেকে নেদারল্যান্ডস ও ব্রাজিলের বিপক্ষে হার এবং পূর্ব জার্মানির সাথে ড্র করে প্রতিযোগিতা থেকে বিদায় নিতে হয় তাদের। প্রতিযোগিতায় ছয়টি খেলার মাত্র একটিতেই জয় পায় আর্জেন্টিনা।

মেনত্তি যুগ: আধিপত্যের সূচনা

বিশ্বকাপের ব্যর্থতা ফুটবল সংস্থাকে আর্জেন্টিনীয় ফুটবলে পরিবর্তন আনতে বাধ্য করে। ১৯৭৪ সালে আর্জেন্টিনীয় ফুটবল সংস্থার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন দেভিদ ব্র্যাকুতো। তিনি সিজার লুইস মেনত্তিকে কোচ হওয়ার জন্য আমন্ত্রন জানান। মেনত্তি কিছু শর্তের বিনিময়ে কোচ হওয়ার জন্য রাজি হন। তার শর্তের মধ্যে একটি হল, পঁচিশ বছরের কম বয়সি কোন খেলোয়ারকে বিদেশী কোন ক্লাবে বিক্রয় করা যাবেনা।

১৯৭৪ সালের ১২ অক্টোবর, স্পেনের বিপক্ষে একটি প্রীতি খেলায় কোচ হিসেবে অভিষেক হয় মেনত্তির। ১৯৭৮ সালে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পায় আর্জেন্টিনা। বিশ্বকাপের জন্য লম্বা প্রস্তুতি নিতে শুরু করে তারা। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যে তেত্রিশটি প্রীতি খেলায় অংশগ্রহণ করে তারা। ১৯৭৭ সালে, হাঙ্গেরির বিপক্ষে খেলায় আর্জেন্টিনা দলের হয়ে মাত্র ১৬ বছর বয়সে দিয়েগো মারাদোনার অভিষেক হয়। খেলায় আর্জেন্টিনা ৫–১ ব্যবধানে জয় লাভ করে।

আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপের প্রস্তুতির শেষ অংশ শুরু করে। তারা দক্ষিণ আমেরিকান এবং ইউরোপীয় বিভিন্ন দলের বিপক্ষে প্রীতি খেলায় অংশগ্রহণ করে। যদিও মারাদোনাকে দলের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় বলা হচ্ছিল, মেনত্তি তাকে প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত তালিকায় রাখেননি।

২ জুন ১৯৭৮, বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার প্রথম খেলায় লুকে এবং বার্তোনির গোলে হাঙ্গেরির বিপক্ষে ২–১ ব্যবধানে জয় লাভ করে তারা। দ্বিতীয় খেলায় ফ্রান্সের বিপক্ষেও ২–১ ব্যবধানে জয় লাভ করে দ্বিতীয় পর্বের টিকিট নিশ্চিত করে আর্জেন্টিনা। তৃতীয় খেলায় ইতালির বিপক্ষে ১–০ ব্যবধানে হেরে গ্রুপ এ থেকে দ্বিতীয় অবস্থান অর্জন করে দ্বিতীয় পর্বে পৌছায় তারা। দ্বিতীয় পর্বে ব্রাজিল, পোল্যান্ড এবং পেরুর সাথে গ্রুপ ভাগাভাগি করে আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয় পর্বের প্রথম খেলায় মারিও কেম্পেসের জোড়া গোলে পোল্যান্ডকে ২–০ ব্যবধানে হারায় আর্জেন্টিনা। ব্রাজিলের বিপক্ষে ড্র এবং পেরুকে ৬–০ ব্যবধানে হারিয়ে ফাইনালে পৌছায় মেনত্তির শিষ্যরা। ১৯৭৮ সালের ২৫ জুন, ইস্ত্যাদিও মনুমেন্তালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা। খেলার ৩৮তম মিনিটে দলকে এগিয়ে নিয়ে যান মারিও কেম্পেস। ৮২তম মিনিটে নানিঙ্গার গোলে সমতায় ফেরে নেদারল্যান্ডস। খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। ১০৪তম মিনিটে কেম্পেস খেলায় তার দ্বিতীয় গোল করলে আবারও এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। এরপর ১১৫তম মিনিটে বার্তোনির গোলে ৩–১ ব্যবধানের জয় নিশ্চিত করে তারা। আর্জেন্টিনা তাদের প্রথম বিশ্বকাপ শিরোপা জেতে। ৬ গোল নিয়ে প্রতিযোগিতার সর্বোচ্চ গোলদাতা হন মারিও কেম্পেস।

বিশ্বকাপে সফলতার পর মেনত্তি কোচ হিসেবে তার দায়িত্ব চালিয়ে যান। ১৯৭৯ কোপা আমেরিকার প্রস্তুতি হিসেবে আর্জেন্টিনা কিছু প্রীতি খেলায় অংশগ্রহণ করে। এসময় আর্জেন্টিনার সিনিয়র দলের হয়ে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম গোল করেন দিয়েগো মারাদোনা। খেলায় আর্জেন্টিনা ৩–১ ব্যবধানে জয় লাভ করে। আর্জেন্টিনা ১৯৭৯ কোপা আমেরিকায় ব্রাজিল ও বলিভিয়ার সাথে গ্রুপ ভাগাভাগি করে। উভয় দলের বিপক্ষেই আর্জেন্টিনা ২–১ ব্যবধানে পরাজিত হয়। বলিভিয়ার বিপক্ষে দ্বিতীয় খেলায় তারা ৩–০ ব্যবধানে জয় লাভ করে এবং ব্রাজিলের বিপক্ষে খেলাটি ২–২ সমতায় শেষ হয়। ফলে আর্জেন্টিনাকে প্রতিযোগিতা থেকে বিদায় নিতে হয়।

১৯৭৯ সালে ফিফা বিশ্ব যুব চ্যাম্পিয়নশীপেও মেনত্তির অধীনে অংশগ্রহণ করে আর্জেন্টিনা। দিয়েগো মারাদোনা এবং র‍্যামন দিয়াজের নেতৃত্বে শিরোপা জেতে তারা। এটিই ছিল জাতীয় দলের হয়ে দিয়েগো মারাদোনার প্রথম অফিসিয়াল প্রতিযোগিতা।

ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ১৯৮২ বিশ্বকাপের জন্য কোন বাছাইপর্বে অংশগ্রহণ করতে হয়নি আর্জেন্টিনাকে। তাই তারা বিশ্বকাপের প্রস্তুতি হিসেবে কিছু প্রীতি খেলায় অংশগ্রহণ করে। ১৯৮২ বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করতে তারা স্পেনে পৌছায়। এবারের স্কোয়াড ১৯৭৮ এর স্কোয়াডের উপর ভিত্তি করেই সাজানো হয়, শুধুমাত্র নতুন হিসেবে ছিলেন দিয়েগো মারাদোনা এবং র‍্যামন দিয়াজ। প্রথম খেলায় ক্যাম্প ন্যু-তে বেলজিয়ামের বিপক্ষে ৩–১ ব্যবধানে পরাজিত হয় আর্জেন্টিনা। কিন্তু পরের দুই খেলায় ঘুরে দাড়ায় তারা। তারা হাঙ্গেরির বিপক্ষে ৪–১ এবং এল সালভাদোরের বিপক্ষে ২–০ ব্যবধানে জয় লাভ করে দ্বিতীয় পর্বে পৌছায়। দ্বিতীয় পর্বে তারা ব্রাজিল ও ইতালির সাথে গ্রুপ ভাগাভাগি করে এবং উভয় দলের বিপক্ষেই পরাজিত হয়ে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়ে। পুরো প্রতিযোগিতায় মারাদোনা তার দক্ষতা দেখাতে ব্যর্থ হন।

বিশ্বকাপের ব্যর্থতার কারণে মেনত্তি দলের কোচের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি নেন। ব্যর্থতা সত্ত্বেও মেনত্তির অধীনে দুইটি আন্তর্জাতিক শিরোপা জেতে আর্জেন্টিনা।

মারাদোনা যুগ: ১৯৮৬ ও ১৯৯০ বিশ্বকাপ

মেনত্তির প্রস্থানের পর আর্জেন্টিনার কোচের দায়িত্ব নেন কার্লোস বিলার্দো। ১৯৮৩ সালের মে মাসে চিলির বিপক্ষে খেলায় কোচ হিসেবে বিলার্দোর অভিষেক হয়। খেলাটি ২–২ সমতায় শেষ হয়। কোচ হিসেবে বিলার্দোর প্রথম অফিসিয়াল প্রতিযোগিতা ছিল ১৯৮৩ কোপা আমেরিকা। প্রতিযোগিতায় আর্জেন্টিনা তিনটি খেলায় ড্র করে (দুইটি ইকুয়েডরের বিপক্ষে এবং একটি ব্রাজিলের বিপক্ষে) এবং ব্রাজিলের বিপক্ষে একটি খেলায় ১–০ ব্যবধানে জয় লাভ করে। ফলে আর্জেন্টিনাকে প্রতিযোগিতা থেকে বিদায় নিতে হয়।

কোপা আমেরিকার পর আর্জেন্টিনা দল নেহরু কাপে অংশগ্রহণ করার জন্য কলকাতা ভ্রমণ করে। এরপর ১৯৮৬ মেক্সিকো বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের আগে তারা একটানা কিছু প্রীতি খেলায় অংশগ্রহণ করে। ১৯৮৫ সালের মে মাসে, বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের প্রথম খেলায় ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে ৩–২ ব্যবধানে জয় লাভ করলেও, বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব টপকাতে অনেক দূর্ভোগ পোহাতে হয় বিলার্দোর শিষ্যদের। দলের দূরবস্থার জন্য আর্জেন্টিনীয় গণমাধ্যম বিলার্দোকে দায়ী করে। কিছু সাংবাদিক আর্জেন্টিনার ঐতিহাসিক ছোট ছোট পাস এবং ড্রিবলিং-এর বৈশিষ্ট্য ত্যাগ করে দলকে ডিফেন্সিভ কৌশলে খেলানোর অভিযোগ করেন। আর্জেন্টিনার সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদপত্র ক্ল্যারিন কোচের একটি শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ছিল। বিলার্দো দাবী করেন, ক্ল্যারিন আর্জেন্টিনীয় ফুটবল সংস্থার প্রেসিডেন্ট জুলিও গ্রোন্দোনার কাছে কোচকে বরখাস্ত করার দাবী জানিয়েছে।

আর্জেন্টিনা দিয়েগো মারাদোনার জন্য অনেক আশা নিয়ে ১৯৮৬ বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করে। তারা ইতালি, বুলগেরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে গ্রুপ ভাগাভাগি করে। প্রথম খেলায় দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ৩–১ ব্যবধানের সহজ জয় তুলে নেয় বিলার্দো শিষ্যরা। দ্বিতীয় খেলায় তারা কঠিন প্রতিপক্ষ ইতালির মুখোমুখি হয়। খেলাটি ১–১ সমতায় শেষ হয়। তৃতীয় খেলায় বুলগেরিয়ার বিপক্ষে ২–০ ব্যবধানে জয় লাভ করে তারা। রাউন্ড অব ১৬-তে আর্জেন্টিনা প্রতিপক্ষ হিসেবে পায় দক্ষিণ আমেরিকান প্রতিদ্বন্দ্ব্বী উরুগুয়েকে। খেলায় আর্জেন্টিনা ১–০ ব্যবধানে জয় লাভ করে। কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ডের। খেলার প্রথমার্ধ গোলশূন্যভাবে শেষ হয়। দ্বিতীয়ার্ধ শুরুর ছয় মিনিট পর মারাদোনা একটি গোল করে দলকে এগিয়ে নিয়ে যান। তবে গোলটি তিনি করেন হাত দিয়ে। পরবর্তীতে তিনি এর নাম দেন, ‘‘La mano de Dios’’ (ঈশ্বরের হাত)। এই গোলের ঠিক চার মিনিট পর তিনি আরও একটি গোল করে ব্যবধান দ্বিগুন করেন। এই গোলটি ‘‘শতাব্দির সেরা গোল’’ হিসেবে খ্যাত। মারাদোনা পুরোপুরি একক নৈপূন্যে পাঁচজন ইংরেজ মাঝমাঠের খেলোয়াড়কে কাটিয়ে এবং গোলরক্ষকে বোকা বানিয়ে গোলটি করেছিলেন। আর্জেন্টিনা খেলায় ২–১ ব্যবধানে জয় লাভ করে।

সেমিফাইনালে মারাদোনার জোড়া গোলে বেলজিয়ামের বিপক্ষে ২–০ ব্যবধানে জয় লাভ করে আর্জেন্টিনা। ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে শাসরুদ্ধকর খেলায় ৩–২ ব্যবধানে জয় লাভ করে তারা। এটি ছিল তাদের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা। বিশ্বকাপে ছয়টি খেলার পাঁচটিতে জয় লাভ করে আর্জেন্টিনা এবং দূর্দান্ত নৈপূন্য প্রদর্শন করেন দিয়েগো মারাদোনা। তিনি পাঁচ গোল করে প্রতিযোগিতায় আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। তাকে প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত করা হয় এবং স্বর্ণজুতা পুরস্কার দেওয়া হয়।

বিশ্বকাপের পর থেকে ১৯৮৭ সালের আগ পর্যন্ত আর্জেন্টিনা কোন খেলায় অংশগ্রহণ করেনি। এরপর তারা অংশগ্রহণ করে ১৯৮৭ কোপা আমেরিকায়। প্রথম খেলায় তারা পেরুর মুখোমুখি হয়। খেলাটি ১–১ সমতায় শেষ হয়। দ্বিতীয় খেলায় ইকুয়েডরকে ৩–০ ব্যবধানে হারায় তারা। দ্বিতীয় পর্বে উরুগুয়ের বিপক্ষে ১–০ ব্যবধানে হেরে প্রতিযোগিতা থেকে বিদায় নেয় আর্জেন্টিনা।

কোপা আমেরিকা শেষে অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ করে আর্জেন্টিনা। কিন্তু সেখানে তারা ভাল ফলাফল অর্জন করতে পারেনি। অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে ১৯৮৯ কোপা আমেরিকার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে আর্জেন্টিনা। কোপা আমেরিকার প্রথম পর্বে তারা চিলি ও উরুগুয়েকে ১–০ ব্যবধানে হারায় এবং ইকুয়েডর ও বলিভিয়ার বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র করে। দ্বিতীয় পর্বে উরুগুয়ে এবং ব্রাজিল উভয়ের বিপক্ষেই ২–০ ব্যবধানে পরাজিত হয় আর্জেন্টিনা। কেবলমাত্র প্যারাগুয়ের বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র করে তারা। ফলে তাদেরকে প্রতিযোগিতা থেকে বিদায় নিতে হয়।

১৯৯০ বিশ্বকাপের জন্য আর্জেন্টিনাকে কোন বাছাইপর্বে অংশগ্রহণ করতে হয়নি। বিশ্বকাপে ক্যামেরুনের বিপক্ষে প্রথম খেলায় ১–০ ব্যবধানে পরাজিত হয় তারা। এই ফলাফল আর্জেন্টিনাকে বিস্মিত করে। তাদের দ্বিতীয় খেলায় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে তারা ২–০ ব্যবধানে জয় লাভ করে। তৃতীয় খেলায় তারা রোমানিয়ার বিপক্ষে ১–১ গোলে ড্র করে দ্বিতীয় পর্বে খেলার সুযোগ পায়। দ্বিতীয় পর্বে আর্জেন্টিনা প্রতিপক্ষ হিসেবে পায় ব্রাজিলকে। খেলায় আর্জেন্টিনা ১–০ ব্যবধানে জয় লাভ করে। কোয়ার্টার ফাইনালে যুগোস্ল্যাভিয়ার বিপক্ষে পেনাল্টিতে জয় পায় আর্জেন্টিনা। সেমিফাইনালে ইতালির মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা। খেলার নব্বই মিনিট ১–১ সমতায় শেষ হলে, খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ে কোনও দলই গোল করতে না পারায় খেলা গড়ায় পেনাল্টি শুটআউটে। পেনাল্টিতে জয় লাভ করে ফাইনালে পৌছায় আর্জেন্টিনা। টানা দ্বিতীয়বারের মত বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা ও জার্মানি। ফাইনালে বিতর্কিত পেনাল্টি থেকে খেলার একমাত্র গোলটি করেন জার্মানির আন্দ্রেস ব্রেহমি। শিরোপার খুব কাছে এসেও তা হাতছাড়া হয়ে যায় আর্জেন্টিনার। ১৯৯০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা চার বছর আগের সেই নৈপূন্য দেখাতে পারেনি। বিশেষ করে দিয়েগো মারাদোনা, যিনি ইনজুরি আক্রান্ত অবস্থায় পুরো প্রতিযোগিতায় খেলেছেন।

বাসিলের আগমন

১৯৯০ বিশ্বকাপের পর বিলার্দো কোচের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি মনে করেন যে তার সময় শেষ হয়ে এসেছে। তার সাথে মারাদোনাও ঘোষণা করেন যে ১৯৯০ বিশ্বকাপই আর্জেন্টিনার হয়ে তার খেলা শেষ প্রতিযোগিতা।

বিলার্দোর বদলি হিসেবে অ্যালফিয়ো বাসিলের নাম ঘোষণা করা হয়। কোচ হিসেবে বাসিলের অভিষেক হয় হাঙ্গেরির বিপক্ষে। খেলায় আর্জেন্টিনা খেলায় ২–০ ব্যবধানে জয় লাভ করে। এরপর আর্জেন্টিনা কিছু প্রীতি খেলায় অংশগ্রহণ করে। ১৯৯১ সালের মার্চে, ইতালিতে একটি ড্রাগ টেস্টে কোকেইনের জন্য ব্যর্থ হন মারাদোনা। ফলে তাকে পনের মাসের জন্য বরখাস্ত করা হয়।

১৯৯১ সালে বাসিলের অধীনে প্রথম অফিসিয়াল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে আর্জেন্টিনা। চিলিতে অনুষ্ঠিত কোপা আমেরিকায় তারা চ্যাম্পিয়ন হয়। ৩২ বছর পর এই শিরোপা জেতে তারা। প্রথম পর্বে ভেনেজুয়েলা (৩–০), চিলি (১–০) এবং প্যারাগুয়ের (৪–১) বিপক্ষে জয় লাভ করে আর্জেন্টিনা। ফাইনাল পর্বে আলবিসেলেস্তেরা ব্রাজিলের বিপক্ষ ৩–২ ব্যবধানে দূর্দান্ত জয় লাভ করে। পরের খেলায় চিলির সাথে গোলশূন্য ড্র করে তারা। তৃতীয় এবং শেষ খেলায় কলম্বিয়ার বিপক্ষে ২–১ ব্যবধানে জয় লাভ করে পয়েন্ট তালিকার শীর্ষে থেকে শিরোপা জেতে আর্জেন্টিনা। ছয় গোল করে প্রতিযোগিতার সর্বোচ্চ গোলদাতা হন গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা।

১৯৯৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, আর্জেন্টিনা দলে ফেরেন দিয়েগো মারাদোনা। সেবছর আর্জেন্টিনা ইকুয়েডরে অনুষ্ঠিত কোপা আমেরিকায় অংশগ্রহণ করে এবং টানা দ্বিতীয়বারের মত শিরোপা জেতে। মারাদোনা ফুটবলে ফিরে আসলেও কোপা আমেরিকার স্কোয়াডে তিনি ছিলেন না, তাই প্রতিযোগিতায় ১০ নম্বর জার্সি পরে মাঠে নামেন দিয়েগো সাইমন।

প্রথম পর্বে মেক্সিকো ও কলম্বিয়া উভয়ের বিপক্ষে ১–১ গোলে ড্র করে আর্জেন্টিনা। বলিভিয়ার বিপক্ষে ১–০ ব্যবধানে জয় লাভ করে কোয়ার্টার ফাইনালে পৌছায় তারা। কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে খেলা ১–১ সমতায় শেষ হলে পেনাল্টিতে জয় পায় আর্জেন্টিনা। সেমিফাইনালেও কলম্বিয়ার বিপক্ষে পেনাল্টিতে জয় পায় তারা। ফাইনালে মেক্সিকোর বিপক্ষে বাতিস্তুতার জোড়া গোলে ২–১ ব্যবধানে জয় লাভ করে তাদের চতুর্দশ কোপা আমেরিকা শিরোপা জেতে আর্জেন্টিনা। এটিই আর্জেন্টিনার সর্বশেষ কোপা আমেরিকা শিরোপা।

কোপা আমেরিকার পর আর্জেন্টিনাকে ১৯৯৪ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে অংশগ্রহণ করতে হয়। তারা কলম্বিয়া, পেরু এবং প্যারাগুয়ের সাথে গ্রুপ ভাগাভাগি করে। পেরু (১–০) এবং প্যারাগুয়ের (৩–১) বিপক্ষে জয় লাভ করলেও, কলম্বিয়ার বিপক্ষে ২–১ ব্যবধানে পরাজিত হয় তারা। পরের খেলায় বুয়েনোস আইরেসে পেরুকে ২–১ ব্যবধানে হারায় আর্জেন্টিনা। প্যারাগুয়ের বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র করলেও, কলম্বিয়ার বিপক্ষে ৫–০ গোলের বড় ব্যবধানে পরাজিত হয় তারা। ফলে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের প্লে-অফে খেলার প্রয়োজন দেখা দেয়। আর্জেন্টিনাকে খেলতে হয় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। প্রথম খেলাটি গোলশূন্য ড্র হয়। দ্বিতীয় খেলায় বুয়েনোস আইরেসে বাতিস্তুতার একমাত্র গোলে জয় পায় স্বাগতিকরা। এই জয়ের ফলে বিশ্বকাপের টিকিটও পেয়ে যায় বাসিলের শিষ্যরা।

১৯৯৪ বিশ্বকাপের প্রস্তুতি হিসেবে কিছু প্রীতি খেলায় অংশগ্রহণ করে আর্জেন্টিনা। বিশ্বকাপে তাদের প্রথম খেলায় গ্রীসকে ৪–০ ব্যবধানে বিধস্ত করে তারা। খেলায় হ্যাট্রিক করেন বাতিস্তুতা এবং একটি গোল করেন মারাদোনা। এই গোলটিই ছিল বিশ্বকাপে মারাদোনার শেষ গোল। দ্বিতীয় খেলায় নাইজেরিয়াকে ২–১ ব্যবধানে হারায় তারা। এই খেলার পর সকলে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপে একটি শক্ত প্রতিদ্বন্দ্ব্বী হিসেবে দেখতে শুরু করে। এছাড়া দলের কিছু খেলোয়াড় দূর্দান্ত ফর্মে ছিলেন। খেলার পর মারাদোনাকে ড্রাগ টেস্টের জন্য ডাকা হয় এবং টেস্টের ফলাফল হ্যাঁ-সূচক হওয়ার কারণে আর্জেন্টিনীয় ফুটবল সংস্থার তত্‍কালীন প্রেসিডেন্ট জুলিও গ্রান্দোনি বড় ধরনের কোন শাস্তি এড়ানোর জন্য তাকে প্রতিযোগিতা থেকে বাদ দিয়ে দেন। ফিফা মারাদোনাকে ১৫ মাসের জন্য বরখাস্ত করে।

প্রথম পর্বের শেষ খেলায় বুলগেরিয়ার বিপক্ষে পরাজিত হয় আর্জেন্টিনা। রাউন্ড অব ১৬-তে রোমানিয়ার বিপক্ষে ৩–২ ব্যবধানে হেরে প্রতিযোগিতা থেকে বিদায় নেয় তারা।

১৯৯৮ ও ২০০২ বিশ্বকাপ

দেনিয়েল প্যাসারেলার অধীনে ১৯৯৮ বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব সহজভাবেই পার হয় আর্জেন্টিনা। বিশ্বকাপের প্রথম পর্বে তারা জাপান (১–০), জামাইকা (৫–০) এবং ক্রোয়েশিয়ার (১–০) বিপক্ষে জয় লাভ করে পুরো ৯ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় পর্ব নিশ্চিত করে। দ্বিতীয় পর্বে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা ২–২ (বাতিস্তুতা ও জানেত্তি) সমতায় শেষ হলে পেনাল্টিতে জয় পায় আর্জেন্টিনা। কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ২–১ ব্যবধানে পরাজিত হয়ে প্রতিযোগিতা থেকে বিদায় নেয় আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনার পক্ষে একমাত্র গোলটি করেন ক্লাউদিও লোপেজ। বিশ্বকাপ ব্যর্থতার পর কোচের দায়িত্ব থেকে সরে দাড়ান প্যাসারেলা। তার পরিবর্তে দায়িত্বে আসেন মার্সেলো বিয়েলসা।

২০০২ কোরিয়া/জাপান বিশ্বকাপে ফেভারিট দল হিসেবে অংশগ্রহণ করে আর্জেন্টিনা। প্রথম পর্বের প্রথম খেলায় নাইজেরিয়ার বিপক্ষে বাতিস্তুতার একমাত্র গোলে জয় পায় আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয় খেলায় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১–০ ব্যবধানে পরাজিত হয় তারা। সুইডেনের বিপক্ষে তৃতীয় খেলাটি ১–১ (ক্রেসপো) সমতায় শেষ হয়। ফলে প্রথম পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয় আর্জেন্টিনাকে।

২০০৬ বিশ্বকাপ

২০০৬ জার্মানি বিশ্বকাপে ভাল ফলাফলের আশা নিয়ে অংশগ্রহণ করে আর্জেন্টিনা। প্রথম পর্বে কোত দিভোয়ার (২–১) ও সার্বিয়া এবং মন্টেনেগ্রোর (৬–০) বিপক্ষে জয় লাভ করে তারা। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে প্রথম পর্বের শেষ খেলাটি গোলশূন্য ড্র হয়। দ্বিতীয় পর্বে মেক্সিকোর বিপক্ষে খেলায় অতিরিক্ত সময়ে ২–১ ব্যবধানে জয় লাভ করে আর্জেন্টিনা। জয়সূচক গোলটি করেন মাক্সি রোদ্রিগেস। ফিফার অনলাইন জরিপে গোলটি বিশ্বকাপের সেরা গোল নির্বাচিত হয়। কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে খেলাটি ১–১ সমতায় শেষ হলে পেনাল্টিতে ৪–২ ব্যবধানে জয় পায় জার্মানি। খেলা শেষে আর্জেন্টিনীয় এবং জার্মান খেলোয়াড়দের মধ্যে ঝগড়ার সূত্রপাত ঘটে।

বিশ্বকাপের পরেই কোচ হোসে পেকারম্যান পদত্যাগ করেন। তার উত্তরসূরি হিসেবে অ্যালফিও বাসিলকে পুনরায় নিয়োগ দেয় এএফএ, যিনি ১৯৯৪ বিশ্বকাপের সময় দলের কোচ ছিলেন।

২০০৭ কোপা আমেরিকা

২০০৭ কোপা আমেরিকায় আর্জেন্টিনা প্যারাগুয়ে, কলম্বিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গ্রুপ ভাগাভাগি করে। প্রথম পর্বের প্রথম খেলায় যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ৪–১ ব্যবধানে জয় লাভ করে আর্জেন্টিনা। খেলায় জোড়া গোল করেন ক্রেসপো। অপর দুইটি গোল দুইটি করেন কার্লোস তেবেস এবং পাবলো আইমার। দ্বিতীয় খেলায় কলম্বিয়ার বিপক্ষে ৪–২ ব্যবধানে জয় পায় আর্জেন্টিনা। জোড়া গোল করেন রিকুয়েলমে এবং অপর গোল দুইটি করেন এর্নান ক্রেসপো ও দিয়েগো মিলিতো। প্রথম পর্বের শেষ খেলায় প্যারাগুয়ের বিপক্ষে হ্যাভিয়ের মাশ্চেরানোর একমাত্র গোলে জয় পায় আর্জেন্টিনা। কোয়ার্টার ফাইনালে পেরুকে ৪–০ ব্যবধানে পরাজিত করে আর্জেন্টিনা। পুনরায় জোড়া গোল করেন রিকুয়েলমে এবং অপর গোল দুইটি করেন লিওনেল মেসি ও মাশ্চেরানো। সেমি ফাইনালে মেক্সিকোর বিপক্ষে হেইনস্, মেসি এবং রিকুয়েলমের গোলে ৩–০ ব্যবধানে জয় লাভ করে আর্জেন্টিনা। ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে ৩–০ ব্যবধানে হেরে শিরোপা হাতছাড়া হয় লা আলবিসেলেস্তেদের।

২০১০ বিশ্বকাপ

আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলের ইতিহাস 
২০১০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হয়ে খেলছেন মেসি (মাঝখানে) ও ডি মারিয়া (ডানে) এবং জার্মানির হয়ে খেলছেন পোদোলস্কি (বামে)।

২০১০ ফিফা বিশ্বকাপের পূর্বে জাতীয় দলের কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় দিয়েগো মারাদোনাকে। বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা গ্রুপ ভাগাভাগি করে নাইজেরিয়া, গ্রিস এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে। প্রথম খেলায় হেইনসের একমাত্র গোলে নাইজেরিয়া বিপক্ষে জয় পায় আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয় খেলায় গঞ্জালো হিগুয়েইনের হ্যাট্রিকে ৪–১ ব্যবধানে দক্ষিণ কোরিয়াকে হারায় আর্জেন্টিনা। প্রথম পর্বের শেষ খেলায় গ্রিসের বিপক্ষে ২–০ ব্যবধানের জয় পায় তারা।

দ্বিতীয় পর্বে আর্জেন্টিনার মুখোমুখি হয় মেক্সিকো। লিওনেল মেসির ক্রস থেকে খেলার প্রথম গোলটি করেন কার্লোস তেবেস। গোলটি পরিষ্কার অফসাইড ছিল। আর্জেন্টিনা খেলায় ৩–১ ব্যবধানে জয় লাভ করে। আর্জেন্টিনার পক্ষে দ্বিতীয় গোলটি করেন গঞ্জালো হিগুয়েইন এবং তৃতীয় গোলটি পুনরায় করেন কার্লোস তেবেস। কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে আর্জেন্টিনা ৪–০ ব্যবধানে পরাজিত হয়। ফলে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপের ইতি ঘটে।

২০১১ কোপা আমেরিকা

কোচ হিসেবে সার্জিও বাতিস্তার প্রথম প্রতিযোগিতা ছিল ২০১১ কোপা আমেরিকা। বলিভিয়ার বিপক্ষে ১–১ গোলে ড্র নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু করে আর্জেন্টিনা। কলম্বিয়ার বিপক্ষে দ্বিতীয় খেলাটি গোলশূন্য ড্র হয়। কোস্টা রিকার বিপক্ষে তৃতীয় খেলায় ৩–০ ব্যবধানে জয় পায় আর্জেন্টিনা। কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনা প্রতিপক্ষ হিসেবে পায় উরুগুয়েকে। পেনাল্টিতে ৫–৪ ব্যবধানে হেরে প্রতিযোগিতা থেকে বিদায় নেয় আর্জেন্টিনা। একটি পেনাল্টি মিস করেন কার্লোস তেবেস। প্রতিযোগিতার পর বাতিস্তাকে বরখাস্ত করে কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় আলেহান্দ্রো সাবেয়াকে। অার্জেনন্টিনা ফুটবল দল ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে ২য় রাউন্ডে উঠে ফ্রান্সের সাথে ৩-৪ গোলে হেরে গিয়ে বিশ্বকাপ থেকে বিদার নেয়।

তথ্যসূত্র

গ্রন্থতালিকা

বহিঃসংযোগ

Tags:

আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলের ইতিহাস ইতিহাসআর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলের ইতিহাস তথ্যসূত্রআর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলের ইতিহাস গ্রন্থতালিকাআর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলের ইতিহাস বহিঃসংযোগআর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলের ইতিহাসআর্জেন্টিনাআর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলউরুগুয়েকোপা আমেরিকাফিফা বিশ্বকাপফুটবল১৯৭৮ ফিফা বিশ্বকাপ১৯৮৬ ফিফা বিশ্বকাপ২০২২ ফিফা বিশ্বকাপ

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

চণ্ডীমঙ্গলআকিদামুসাফিরের নামাজপেট্রোবাংলাঅর্থ (টাকা)সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানী লিমিটেডরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাবপ্রাণ-আরএফএল গ্রুপহিমালয় পর্বতমালাসৌদি রিয়ালবাংলাদেশের জেলাসমূহের তালিকাইসরায়েলের জনসংখ্যার পরিসংখ্যানদারুল উলুম দেওবন্দঅগ্নিমিত্রা পালমুসাভারতের জাতীয় পতাকাকালেমাচীনরিলায়েন্স ফাউন্ডেশনমাইটোসিসচাঁদপুর জেলাওমানইন্দ্র (দেবতা)আলুরশিদ চৌধুরীইউসুফবেদে জনগোষ্ঠীই-মেইলবৈদিক যুগরশীদ খানচৈতন্যচরিতামৃতবিজরী বরকতুল্লাহমমতা বন্দ্যোপাধ্যায়আমার সোনার বাংলাবাংলা একাডেমিভারতের ইতিহাসসাইবার অপরাধদ্বাদশ জাতীয় সংসদ সদস্যদের তালিকাহাতিশুঁড়লিঙ্গ উত্থান ত্রুটিমারমাকৃত্রিম উপগ্রহও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদরূপান্তরিত লিঙ্গবাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসটুইটারশাকিব খান অভিনীত চলচ্চিত্রের তালিকাইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সংঘাতকুমিল্লাআবু বকরহামাসসানি লিওনমুহাম্মাদ ফাতিহআসসালামু আলাইকুমসোনালী ব্যাংক পিএলসিইরাকময়মনসিংহ বিভাগকুমিল্লা জেলাবিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সদৈনিক যুগান্তরচর্যাপদপান (পাতা)ইব্রাহিম রাইসিতাহসান রহমান খানবিদ্যাপতিহরপ্পারামমোহন রায়কুরআনের ইতিহাসপাবনা জেলাবাংলা সাহিত্যকামরুল হাসানপেশামাযহাবলালবাগের কেল্লাদ্বিতীয় মুরাদযোহরের নামাজহামযক্ষ্মা🡆 More