পর্যায় সারণি

পর্যায় সারণি (যা মৌলসমূহের পর্যায় সারণি নামেও পরিচিত) যেখানে রাসায়নিক মৌলসমূহকে সারি (পর্যায়) এবং স্তম্ভ (গ্রুপ) আকারে সাজানো হয়। এটি রসায়নের একটি সংগঠিত প্রতীক এবং এটি পদার্থবিজ্ঞান ও অন্যান্য বিজ্ঞানে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এটি পর্যায় আইনের একটি চিত্র, যা বলে যে যখন মৌলসমূহকে তাদের পারমাণবিক সংখ্যা অনুসারে সাজানো হয় তখন তাদের বৈশিষ্ট্যের একটি আনুমানিক পুনরাবৃত্তি স্পষ্ট হয়। সারণিটি চারটি আনুমানিক আয়তাকার এলাকায় বিভক্ত যাকে ব্লক বলা হয়। একই গ্রুপের মৌলসমূহ একই রকম রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে।

পর্যায় সারণি
রাসায়নিক মৌলসমূহের পর্যায় সারণি যাতে সর্বাধিক বা আরও সাধারণভাবে নামকরণ করা মৌলসমূহের সেটগুলো (পর্যায় সারণিতে) এবং ধাতু ও অধাতুর মধ্যে একটি বিভাজনকারী রেখা দেখানো হয়েছে। f-ব্লকটি আসলে গ্রুপ ২ এবং ৩ এর মধ্যে অবস্থান।সৌন্দর্য্য বর্ধন ও জায়গা বাচানোর জন্য এটি সাধারণত সারণির পাদদেশে দেখানো হয়।

পর্যায় সারণিতে উল্লম্ব, অনুভূমিক এবং তির্যক প্রবণতা দেখা যায়। একটি গ্রুপে নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে ধাতব বৈশিষ্ট্য বৃদ্ধি পায় এবং একটি পর্যায়ে বাম থেকে ডান দিকে অতিক্রম করার সঙ্গে তা হ্রাস পায়। পর্যায় সারণির নিচের বাম থেকে উপরের ডান দিকে যাওয়ার সঙ্গে অধাতব বৈশিষ্ট্য বৃদ্ধি পায়।

১৮৬৯ সালে রুশ রসায়নবিদ দিমিত্রি মেন্ডেলেভ যে পর্যায় সারণিটি প্রণয়ন করেন তা সর্বপ্রথম সার্বজনীনভাবে গৃহীত হয়। তিনি পারমাণবিক ভরের ওপর রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের নির্ভরতার ভিত্তিতে পর্যায় সারণিটি প্রণয়ন করেন। যেহেতু তখন সকল মৌল আবিষ্কৃত হয়নি, তাই তার পর্যায় সারণিতে অসম্পূর্ণতা ছিল এবং মেন্ডেলেভ সফলভাবে পর্যায় সারণি ব্যবহার করে কিছু অনুপস্থিত মৌলের কিছু বৈশিষ্ট্য পূর্বাভাস করেন। ১৯ শতকের শেষের দিকে পর্যায় সারণিকে মৌলিক আবিষ্কার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ২০ শতকের শুরুতে এটি ব্যাখ্যা করা হয়, পারমাণবিক সংখ্যা আবিষ্কারের মাধ্যমে এবং কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানে সংশ্লিষ্ট অগ্রণী কাজের মাধ্যমে, উভয় ধারণাই পরমাণুর অভ্যন্তরীণ গঠনকে বিকশিত করতে ভূমিকা রাখে। ১৯৪৫ সালে গ্লেন টি. সিবোর্গ আবিষ্কার করেন যে অ্যাক্টিনাইডগুলো আসলে d-ব্লক নয় বরং f-ব্লক মৌল, তারপর থেকে পর্যায় সারণিটির একটি আধুনিক রূপে পৌঁছানো হয়। পর্যায় সারণি এবং আইন এখন আধুনিক রসায়নের একটি কেন্দ্রীয় ও অপরিহার্য অংশ।

বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পর্যায় সারণিটিও বিবর্তিত হতে থাকে। প্রকৃতিতে, পরমাণবিক সংখ্যা ৯৪ পর্যন্ত মৌলই বিদ্যমান; এর বেশি এগিয়ে যেতে, পরীক্ষাগারে নতুন মৌল সংশ্লেষণ করা প্রয়োজন। আজ, যদিও প্রথম ১১৮টি মৌলই পরিচিত, তবে সারণিটি এখনও সম্পূর্ণ নয়। ১১৯ এবং ১২০ নম্বর পারমাণবিক সংখ্যার মৌলগুলোর অস্তিত্বের সম্ভাবনা রয়েছে, এবং বিজ্ঞানীরা এই মৌলগুলো আবিষ্কারের জন্য কাজ করছেন।

বৈশিষ্ট্যসমূহ

পর্যায় সারণি 
পর্যায় সারণি
  • পর্যায় সারণি কতগুলো আনুভূমিক সারি এবং খাড়া স্তম্ভে আছে। সারিগুলোকে "পর্যায়" এবং স্তম্ভ গুলোকে "গ্রুপ" বলা হয়।
  • পর্যায় সারণিতে ৭টি পর্যায় এবং ১৮টি গ্রুপ বিদ্যমান।
  • প্রতিটি পর্যায় বামদিকের গ্রুপ থেকে আরম্ভ করে ডানদিকে গ্রুপ-১৮ পর্যন্ত বিস্তৃত।
  • প্রথম পর্যায় মাত্র দুইটি মৌল বিদ্যমান। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায় ৮টি করে এবং চতুর্থ ও পঞ্চম পর্যায় ১৮টি করে মৌল আছে। ৬ষ্ঠ পর্যায়ে আছে ৩২টি। সপ্তম পর্যায়েও ৩২ টি মৌল রয়েছে।
  • মৌলসমূহের ধর্ম তাদের গ্রুপের ওপর নির্ভর করে। একই গ্রুপভুক্ত মৌলসমূহের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মে যথেষ্ট মিল থাকে, যদিও ধর্মগুলো বিভিন্ন অনুকূমে উপর থেকে নিচের দিকে পরিবর্তিত হয়।
  • একটি পর্যায়ে বামদিক থেকে ডানদিকে মৌলসমূহের ধর্মের ক্রমবিকাশ লক্ষ করা যায়। কোনো গ্রুপে একটি মৌলের সর্বশেষ স্তরের ইলেকট্রন সংখ্যা তার গ্রুপ সংখ্যার সমমানের হয়।
  • গ্রুপ-২ এবং গ্রুপ-৩ এর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থানকারী মৌলগুলোকে "অবস্থান্তর মৌল" বলা হয়। এই পর্যায়ের মৌলগুলোকে নিচে আলাদাভাবে ল্যান্থানাইড ও অ্যাকটিনাইড সারির মৌল হিসেবে দেখানো হলেও এগুলো যথাক্রমে ৬ এবং ৭ পর্যায়ের অংশ।
  • পর্যায়ভিত্তিক মৌল সংখ্যা:
    • পর্যায় ১ এ শুধু ২টি মৌল রয়েছে।
    • পর্যায় ২ এবং পর্যায় ৩ এ ৮টি করে মৌল রয়েছে।
    • পর্যায় ৪ এবং পর্যায় ৫ এ ১৮টি করে মৌল রয়েছে।
    • পর্যায় ৬ এবং পর্যায় ৭ এ ৩২টি করে মৌল রয়েছে।
  • গ্রুপভিত্তিক মৌল সংখ্যা:
    • গ্রুপ ১ এ ৭টি মৌল রয়েছে।
    • গ্রুপ ২ এ ৬টি মৌল রয়েছে।
    • গ্রুপ ৩ এ ৩২টি মৌল রয়েছে।
    • গ্রুপ ৪ থেকে গ্রুপ ১২ পর্যন্ত প্রত্যেকটি গ্রুপে ৪টি করে মৌল রয়েছে।
    • গ্রুপ ১৩ থেকে গ্রুপ ১৭ পর্যন্ত প্রত্যেকটিতে ৬টি করে মৌল রয়েছে।
    • গ্রুপ ১৮ এ ৭টি মৌল রয়েছে।
  • একই পর্যায়ের বাম থেকে ডানের দিকে গেলে মৌলসমূহের ধর্ম ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত হয়৷
  • একই গ্রুপের মৌলগুলোর ভৌত এবং রাসায়নিক ধর্ম প্রায় একই রকমের হয়।

রূপ

সংযোজিত তথ্য, বিন্যাস ও জটিলতার ভিত্তিতে পর্যায় সারণির বেশ কয়েকটি রূপ রয়েছে যথা:

সর্বাধুনিক পর্যায় সারণি

১৯৮৯ সালে ইউপ্যাকের (IUPAC - International Union Of Pure And Applied Chemistry) সিদ্ধান্তক্রমে মৌলের সর্ববহিঃস্থস্তরের ইলেক্ট্রন সংখ্যা অনুযায়ী মৌলের শ্রেণীসংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। আর এভাবেই সর্বাধুনিক পর্যায় সারণির পত্তন ঘটে। এতে মোট ১৮টি শ্রেণী এবং ৭টি পর্যায় রয়েছে। এতে পর্যায়সমূহকে ইংরেজি ১,২,৩,৪,৫,৬,৭ সংখ্যা দ্বারা এবং শ্রেণীসমূহকে রোমান হরফের বদলে ইংরেজি ১,২,৩,৪,৫,৬,৭,৮,৯,১০,১১,১২,১৩,১৪,১৫,১৬,১৭,১৮ সংখ্যাগুলো দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে।

কোন মৌল সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে উক্ত মৌলের নামের উপর ক্লিক করুন

শ্রেণী → ১০ ১১ ১২ ১৩ ১৪ ১৫ ১৬ ১৭ ১৮
↓ পর্যায়

H


He

Li

Be


B

C

N

O

F
১০
Ne
১১
Na
১২
Mg

১৩
Al
১৪
Si
১৫
P
১৬
S
১৭
Cl
১৮
Ar
১৯
K
২০
Ca
২১
Sc
২২
Ti
২৩
V
২৪
Cr
২৫
Mn
২৬
Fe
২৭
Co
২৮
Ni
২৯
Cu
৩০
Zn
৩১
Ga
৩২
Ge
৩৩
As
৩৪
Se
৩৫
Br
৩৬
Kr
৩৭
Rb
৩৮
Sr
৩৯
Y
৪০
Zr
৪১
Nb
৪২
Mo
৪৩
Tc
৪৪
Ru
৪৫
Rh
৪৬
Pd
৪৭
Ag
৪৮
Cd
৪৯
In
৫০
Sn
৫১
Sb
৫২
Te
৫৩
I
৫৪
Xe
৫৫
Cs
৫৬
Ba

  • Lanthanides
৭২
Hf
৭৩
Ta
৭৪
W
৭৫
Re
৭৬
Os
৭৭
Ir
৭৮
Pt
৭৯
Au
৮০
Hg
৮১
Tl
৮২
Pb
৮৩
Bi
৮৪
Po
৮৫
At
৮৬
Rn
৮৭
Fr
৮৮
Ra

    • Actinides
১০৪
Rf
১০৫
Db
১০৬
Sg
১০৭
Bh
১০৮
Hs
১০৯
Mt
১১০
Ds
১১১
Rg
১১২
Cn
১১৩
Nh
১১৪
Fl
১১৫
Mc
১১৬
Lv
১১৭
Ts
১১৮
Og

* ল্যান্থানাইড সারি ৫৭
La
৫৮
Ce
৫৯
Pr
৬০
Nd
৬১
Pm
৬২
Sm
৬৩
Eu
৬৪
Gd
৬৫
Tb
৬৬
Dy
৬৭
Ho
৬৮
Er
৬৯
Tm
৭০
Yb
৭১
Lu
** অ্যাক্টিনাইড সারি ৮৯
Ac
৯০
Th
৯১
Pa
৯২
U
৯৩
Np
৯৪
Pu
৯৫
Am
৯৬
Cm
৯৭
Bk
৯৮
Cf
৯৯
Es
১০০
Fm
১০১
Md
১০২
No
১০৩
Lr

পর্যায় সারণীর রাসায়নিক শ্রেণীসমূহ

ধাতু ধাতুকল্প অধাতু অজানা
রাসায়নিক
বৈশিষ্ট্য
ক্ষার
ধাতু
মৃৎ
ক্ষার ধাতু
অভ্যন্তরীণ রূপান্তর ধাতু অবস্থান্তর
ধাতু
উত্তোলন পরবর্তী
ধাতু
অন্যান্য
অধাতু
হ্যালোজেন নিষ্ক্রিয়
গ্যাস
ল্যান্থানাইড অ্যাক্টিনাইড

বিশেষ দ্রষ্টব্য

  • অ্যাক্টিনাইডল্যান্থানাইড সিরিজের মৌলসমূহকে একত্রে "বিরল মৃত্তিকা ধাতু" নামে অভিহিত করা হয়। এই মৌলগুলোর শ্রেণী সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্যের জন্য এখানে ক্লিক করুন।
  • ক্ষার ধাতু, মৃৎক্ষার ধাতু, অবস্থান্তর মৌল, অন্তঃঅবস্থান্তর মৌল, ল্যান্থানাইড, অ্যাক্টিনাইড এবং দুর্বল ধাতু এই সবগুলোকে একত্রে ধাতু বলা হয়।
  • হ্যালোজেন ও নিষ্ক্রিয় গ্যসসমূহও অধাতু।

অবস্থা

আদর্শ তাপমাত্রা ও চাপ (০°সে. এবং ১ atm) ধর্তব্য

  • যে সমস্ত মৌলের ব্লক red রংয়ের সেগুলো বায়বীয়।
  • যে সমস্ত মৌলের ব্লক green রংয়ের সেগুলো তরল
  • যে সমস্ত মৌলের ব্লক black রংয়ের সেগুলো তরল

প্রকৃতিগত সাংগঠনিক বৈশিষ্ট্যসমূহ

  • যে মৌলগুলোর ব্লকে অবিচ্ছিন্ন সীমারেখা আছে সেগুলো আদিম মৌল, অর্থাৎ তাদের যেকোন একটি স্থিতিশীল আইসোটোপের বয়স পৃথিবীর বয়সের চেয়ে বেশি।
  • যে মৌলগুলোর ব্লকে ড্যাশ আকারের সীমারেখা আছে সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন্যান্য মৌলের তেজস্ক্রিয় ভাঙনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় এবং এগুলোর এমন কোন স্থিতিশীল আইসোটোপ নেই যেটির বয়স পৃথিবীর বয়সের চেয়ে বেশি। তবে এগুলোর মধ্যে কয়েকটিকে কিছু তেজস্ক্রিয় আকরিকের মধ্যে খুব সামান্য পরিমাণে পাওয়া যায়।
  • যে সমস্ত মৌলের ব্লকে ডট আকারের সীমারেখা রয়েছে সেগুলো কৃত্রিম মৌল হিসেবে পরিচিত, অর্থাৎ এগুলো প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়না।

দ্রষ্টব্য: ক্যালিফোর্নিয়াম (Cf) নামক মৌলটি যদিও পৃথিবীতে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়না, তথাপি ক্যালিফোর্নিয়াম এবং এর তেজস্ক্রিয় ভাঙনের মাধ্যমে সৃষ্ট অন্যান্য কিছু মৌল মহাবিশ্বের অন্যান্য স্থানে পাওয়া যায়। বিভিন্ন সুপারনোভা থেকে প্রাপ্ত * বর্ণালীতে এ মৌলসমূহের তড়িৎচৌম্বক বিকিরণ রেখার অস্তিত্ব পাওয়া যায়।

  • যে মৌলগুলোর ব্লকে কোন সীমারেখা নেই সেগুলো প্রকৃতিতেও পাওয়া যায় না এবং কৃত্রিমভাবেও সেগুলোকে এখন পর্যন্ত তৈরি করা সম্ভব হয়নি।

মৌলের অবস্থান চিহ্নিতকরণ

উপশক্তিস্তর: s p d f g
পর্যায়
১s
২s ২p
৩s ৩p
৪s ৪p ৩d
৫s ৫p ৪d
৬s ৬p ৫d ৪f
৭s ৭p ৬d ৫f
৮s ৮p ৭d ৬f ৫g
৯s ৯p ৮d ৭f ৬g

মৌলের পর্যায়বৃত্ত ধর্ম

পর্যায় সারণিতে অবস্থিত মৌলগুলোর কিছু ধর্ম আছে যেমন: ধাতব ধর্ম, অধাতব ধর্ম, পরমাণুর আকার, আয়নিকরণ শক্তি, তড়িৎ ঋণাত্মকতা, ইলেকট্রন আসত্তি ইত্যাদি। এসব ধর্মকে পর্যায়বৃত্ত ধর্ম বলে |

  • ধাতব ধর্ম: যে সকল মৌল এক বা একাধিক ইলেকট্রন ত্যাগ করে ধনাত্মক আয়নে পরিণত হয় তাদেরকে ধাতু বলে। ধাতুর ইলেকট্রন ত্যাগের এই ধর্মকে ধাতব ধর্ম বলে। যে মৌলের পরমাণু যত সহজে ইলেকট্রন ত্যাগ করে পারবে সেই মৌলের ধাতব ধর্ম তত বেশি। পর্যায় সারণিতে যেকোনো পর্যায়ের বাম থেকে ডানে গেলে ধাতব ধর্ম হ্রাস পায়।
  • অধাতব ধর্ম: যেসকল মৌল এক বা একাধিক ইলেকট্রন গ্রহণ করে ঋণাত্মক আয়নে পরিণত হয় তাদেরকে অধাতু বলে। অধাতুর ইলেকট্রন গ্রহণের এই ধর্মকে অধাতব ধর্ম বলে। যে মৌলের পরমাণু যত সহজে ইলেকট্রন গ্রহণ করতে পারবে সেই মৌলের অধাতব ধর্ম তত বেশি। পর্যায় সারণিতে যেকোনো পর্যায়ের বাম থেকে ডানে গেলে অধাতব ধর্ম বৃদ্ধি পায়।

যে সকল মৌল কোনো কোনো সময় ইলেকট্রন ত্যাগ করে এবং কোনো কোনো সময় ইলেকট্রন গ্রহণ করে তাদেরকে উপধাতু বলে।

পর্যায় সারণির যেকোনো একটি পর্যায়ের দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, বাম দিকের মৌলগুলো সাধারণত ধাতু, মাঝের মৌলগুলো সাধারণত অর্ধধাতু বা উপধাতু এবং ডান দিকের মৌলগুলো সাধারণত অধাতু।

  • পরমাণুর আকার/পারমাণবিক ব্যাসার্ধ: পরমাণুর আকার তথা পারমাণবিক ব্যাসার্ধ একটি পর্যায়বৃত্ত ধর্ম। যেকোনো একটি পর্যায়ের যতই বামদিক থেকে ডান দিকে যাওয়া যায় পরমাণুর আকার/পারমাণবিক ব্যাসার্ধ তত কমতে থাকে এবং যেকোনো একটি গ্রুপের যতই উপর দিক থেকে নিচের দিকে যাওয়া যায় পরমাণুর আকার/পারমাণবিক ব্যাসার্ধ তত বাড়তে থাকে।

একই পর্যায়ের বাম দিক থেকে যত ডান দিকে যাওয়া যায় পারমাণবিক সংখ্যা তত বাড়তে থাকে কিছু প্রধান শক্তিস্তরের সংখ্যা বাড়ে না। পারমাণবিক সংখ্যা বাড়লে নিউক্লিয়াসে প্রোটন সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং ইলেকট্রন সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। নিউক্লিয়াসের অধিক প্রোটন সংখ্যা এবং নিউক্লিয়াসের বাইরের অধিক ইলেকট্রন সংখ্যার মধ্যে আকর্ষণ বেশি হয় ফলে ইলেকট্রনগুলোর শক্তিস্তর নিউক্লিয়াসের কাছে চলে আসে, ফলে পরমাণুর আকার ছোট হয়ে যায়।

একই গ্রুপে যতই উপর থেকে নিচের দিকে যাওয়া যায় ততই বাইরের দিকে একটি করে নতুন শক্তিস্তর যুক্ত হয়। একটি করে নতুন শক্তিস্তর যুক্ত হলে পরমাণুর আকার বৃদ্ধি পায়।

একই গ্রুপের উপর থেকে নিচের দিকে গেলে নিউক্লিয়াসের প্রোটন সংখ্যা এবং বাইরের কক্ষপথের ইলেকট্রন সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য আকর্ষণ বৃদ্ধি হয়ে পরমাণুর আকার যতটুকু হ্রাস পায়, নতুন একটি শক্তিস্তর যোগ হওয়ার কারণে পরমাণু আকার তার চেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায়। যে কারণে উপরের মৌলের চেয়ে নিচের মৌলের আকার বড় হয়।

  • আয়নীকরণ শক্তি: গ্যাসীয় অবস্থায় কোনো মৌলের এক মোল গ্যাসীয় পরমাণু থেকে এক মোল ইলেকট্রন অপসারণ করে এক মোল ধনাত্মক আয়নে পরিণত করতে যে শক্তির প্রয়োজন হয়, তাকে ঐ মৌলের আয়নীকরণ শক্তি বলে। আয়নিকরণ শক্তি একটি পর্যায়বৃত্ত ধর্ম একই পর্যায়ের বামের মৌলের পারমাণবিক ব্যাসার্ধ বেশি এবং ডানের মৌলের পারমাণবিক ব্যাসার্ধ কম। পারমাণবিক ব্যাসার্ধ কমলে আয়নীকরণ শক্তির মান বাড়ে এবং পারমাণবিক ব্যাসার্ধ বাড়লে আয়নিকরণ শক্তির মান কমে।
পর্যায় সারণি 
একটি মৌলের আয়নীকরণ।
  • ইলেকট্রন আসক্তি: গ্যাসীয় অবস্থায় কোনো মৌলের এক মোল গাসীয় পরমাণুতে এক মোল ইলেকট্রন প্রবেশ করিয়ে এক মোল ঋণাত্মক আয়নে পরিণত করতে যে শক্তি নির্গত হয়, তাকে ঐ মৌলের ইলেকট্রন আসক্তি বলে। ইলেকট্রন আসক্তি একটি পর্যায়বৃত্ত ধর্ম। একই পর্যায়ের বামের মৌলের পারমাণবিক ব্যাসার্ধ বেশি এবং ডানের মৌলের পারমাণবিক ব্যাসার্ধ কম। পারমাণবিক ব্যাসার্ধ কমলে ইলেকট্রন আসক্তির মান বাড়ে এবং পারমাণবিক ব্যাসার্ধ বাড়লে ইলেকট্রন আসক্তির মান কমে।
  • তড়িৎ ঋণাত্মকতা: দুটি পরমাণু যখন সমযোজী বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে অণুতে পরিণত হয় তখন অণুর পরমাণুগুলো বন্ধনের ইলেকট্রন দুটিকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। এই আকর্ষণকে তড়িৎ ঋণাত্মকতা বলা হয়। তড়িৎ ঋনাত্মকতা একটি পর্যায়বৃত্ত ধর্ম। একই পর্যায়ের বামের মৌলের পারমাণবিক ব্যাসার্ধ বেশি এবং ডানের মৌলের পারমাণবিক ব্যাসার্ধ কম। পারমাণবিক ব্যাসার্ধ কমলে তড়িৎ ঋনাত্মকতার মান বাড়ে এবং পারমাণবিক ব্যাসার্ধ বাড়লে তড়িৎ ঋনাত্মকতার মান কমে। সাধারণত কোনো মৌলের পরমাণুর আকার ছোট হলে তড়িৎ ঋনাত্মকতার মান বেশি হয় এবং কোনো মৌলের পরমাণুর আকার বড় হলে তড়িৎ ঋনাত্মকতার মান কম হয়।

ইতিহাস

পর্যায় সারণি 
পর্যায় সারণির জনক, দিমিত্রি মেন্দেলিয়েভ।

১৭৮৯ সালে রসায়নবিদ অঁতোয়ান লাভোয়াজিয়ে তখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ৩৩ টি রাসায়নিক উপাদানকে ধাতু ও অধাতু, এই দুইভাগে বিভক্ত করেন। যদিও লাভোয়াজিয়ের সমসাময়িক রসায়নবিদগণ আরও উন্নত শ্রেণীবিন্যাসকরণ পদ্ধতির সন্ধান করছিলেন।

১৮২৯ সালে জার্মান রসায়নবিদ ইয়োহান ভোলফগাং ডোবেরেইনার প্রমাণ করেন, তিনটি করে মৌল একই ধর্ম প্রদর্শন করে। তিনি প্রথমে পারমাণবিক ভর অনুযায়ী তিনটি করে মৌল সাজিয়ে মৌলের একটি সারণি তৈরি করেন। ডোবেরেইনার আরো প্রমাণ করেন, ২য় মৌলের পারমাণবিক ভর ১ম ও ৩য় মৌলের পারমাণবিক ভরের অর্ধেক বা গড়ের সমান অথবা কাছাকাছি।একে ডোবেরেইনারের ত্রয়ীসূত্র বলে।

ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী বিজ্ঞানী জন নিউল্যান্ড ১৮৬৪ সালে তখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত মৌলগুলোকে তাদের ভর অনুসারে সাজিয়ে মৌলগুলোর প্রতি অষ্টম মৌলসমূহের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মের মধ্যে মিল পান।

পরবর্তীকালে ১৮৬৯ সালে রুশ বিজ্ঞানী দিমিত্রি মেন্ডেলিফের সকল মৌলের জন্য একটি সাধারণ পর্যায় সূত্র আবিষ্কার করেন, যা হলো- "মৌলসমূহের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম তাদের পারমাণবিক ভর বৃদ্ধির সঙ্গে পর্যায় ক্রমে আবর্তিত হয়"। উক্ত সূত্রানুসারে তিনি ও জার্মান বিজ্ঞানী ইউলিয়ুস লোটার মাইয়ার মিলে আধুনিক পর্যায় সারণি প্রকাশ করেন। তখন ৬৭ টি মৌল নিয়ে পর্যায় সারণি গঠিত হয়েছিল যার মধ্যে ৬৩ টি আবিষ্কৃত হয়েছিলো। ১৯০০ সালের মধ্যে আরও ৩০ টি মৌল পর্যায় সারণিতে যুক্ত হয়। এভাবেই সূচনা হয় আধুনিক পর্যায় সারণির।

প্রথমদিকে পারমাণবিক ভরের উপর নির্ভর করে পর্যায় সারণি সাজানো হয়েছিল। কিন্তু এতে মৌলের ধর্মের শ্রেণিবিন্যাসকরণে ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। ১৯১৩ সালে রসায়নবিদ হেনরি মোসলে পারমাণবিক ভরের বদলে পারমাণবিক সংখ্যা অনুযায়ী মৌলসমূহকে সাজানোর প্রস্তাব দেন। বর্তমানে আধুনিক পর্যায় সারনির জনক তাকে বলা হয়

উপকারিতা

রসায়ন অধ্যয়ন, নতুন মৌল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী, গবেষণা ইত্যাদিতে পর্যায় সারণি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তার কয়েকটি উদাহরণ হলো:

  • রসায়ন পাঠ সহজীকরণ: ২০১৬ সাল পর্যন্ত পৃথিবীতে ১১৮ টি মৌল আবিষ্কার করা হয়েছে। যদি শুধু পদার্থের ৪ টি ভৌত ধর্ম, যেমন গলনাঙ্ক, স্ফুটনাঙ্ক, ঘনত্ব ও কঠিন/তরল/গ্যাসীয় অবস্থা এবং ৪ টি রাসায়নিক ধর্ম, যেমন– অক্সিজেন, পানি, এসিডক্ষারের সাথে বিক্রিয়া বিবেচনা করা হয় তাহলে ১১৮ টি মৌলের মোট ১১৮×(৪+৪)= ৯৪৪ টি ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। পর্যায় সারণির ফলে এই ৯৪৪টি ধর্মের বিন্যাসের কাজটিকে অনেক সহজ হয়ে গেছে। পর্যায় সারণিতে রয়েছে আঠারোটি গ্রুপ আর সাতটি পর্যায়, যেখানে এই সকল ধর্ম অনুযায়ী পদার্থগুলোর বিন্যাস করা হয়েছে।
  • নতুন মৌলের আবিষ্কার: পর্যায় সারণির উদ্ভাবনকালে সাতটি পর্যায় আর আঠারোটি গ্রুপ নিয়ে গঠিত পর্যায় সারণিতে অনেকগুলো ফাঁকা ঘর ছিল। এই মৌলগুলো আবিষ্কার হবার আগেই ঐ ফাঁকা ঘরে যে মৌলগুলো বসবে বা তাদের ধর্ম কেমন হবে তা পর্যায় সারণি থেকে ধারণা পাওয়া গিয়েছিল। বিজ্ঞানী মেন্ডেলিফ তাঁর সময়ে আবিষ্কৃত ৬৩ টি মৌলকে তার আবিষ্কৃত পর্যায় সারণিতে স্থান দিতে গিয়ে যে মৌলগুলো সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন সেগুলো পরে আবিষ্কৃত হয়েছিল।
  • গবেষণা ক্ষেত্রে: গবেষণাগারে কোনো নতুন পদার্থ তৈরির ক্ষেত্রে পদার্থের ধর্ম ও উপাদান সম্পর্কিত ধারণা লাভের ক্ষেত্রে পর্যায় সারণি ব্যবহার করা হয়।

বিকল্প সারণি

পর্যায় সারণি 
থিওডোর বেনফের পর্যায় সারণি (১৯৬৪)

বিকল্প পর্যায় সারণি হলো মৌলসমূহের একটি ছক যা মূল পর্যায় সারণি থেকে ভিন্ন হয়। এখন পর্যন্ত হাজারেরও বেশি বিকল্প সারণি প্রস্তাব করা হয়েছে, কারণ মৌলসমূহের মধ্যকার সকল পারস্পরিক সম্পর্ক সবসময় নিয়মিত ব্যবহার্য পর্যায় সারণি দিয়ে উপলব্ধি করা যায় না।

আরও দেখুন

বহিঃসংযোগ

টীকা

তথ্যসূত্র

Tags:

পর্যায় সারণি বৈশিষ্ট্যসমূহপর্যায় সারণি সর্বাধুনিক পর্যায় সারণি মৌলের পর্যায়বৃত্ত ধর্মপর্যায় সারণি ইতিহাসপর্যায় সারণি উপকারিতাপর্যায় সারণি বিকল্প সারণিপর্যায় সারণি আরও দেখুনপর্যায় সারণি বহিঃসংযোগপর্যায় সারণি টীকাপর্যায় সারণি তথ্যসূত্রপর্যায় সারণিপদার্থবিজ্ঞানপর্যায় (পর্যায় সারণি)ব্লক (পর্যায় সারণি)

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

মুহাম্মাদের সন্তানগণবিশ্ব থিয়েটার দিবসধর্মআডলফ হিটলারকোকা-কোলা২০২৩ নেদারল্যান্ডসে অস্ট্রিয়া পুরুষ ক্রিকেট দল বনাম জার্মানিসংস্কৃত ভাষাবাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পদবিকালেমামহাদেশ অনুযায়ী সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং নির্ভরশীল অঞ্চলসমূহের তালিকারোহিত শর্মাতেজস্ক্রিয়তাড্যারিল মিচেলরমজান (মাস)আব্বাসীয় খিলাফতগ্রামীণফোনএশিয়ার সার্বভৌম রাষ্ট্র ও নির্ভরশীল অঞ্চলসমূহের তালিকাস্পিন (পদার্থবিজ্ঞান)শীলা আহমেদব্যাকটেরিয়াহরিচাঁদ ঠাকুরমেয়েবসুন্ধরা সিটিমতিউর রহমান নিজামীরাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়পুরুষাঙ্গের চুল অপসারণজাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদগ্রিনহাউজ গ্যাসযুক্তরাজ্যমাশাআল্লাহচাঁদথ্যালাসেমিয়াবাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মরত জেনারেলদের তালিকা২০২৬ ফিফা বিশ্বকাপসুফিয়া কামালশীর্ষে নারী (যৌনাসন)কুরআনের সূরাসমূহের তালিকাবাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীশেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডবিশেষণভারত বিভাজনদারাজবাংলাদেশ বিমান বাহিনীপশ্চিমবঙ্গক্যাসিনোবৃষ্টিসূরা বাকারাবীর উত্তমবিভিন্ন ধর্ম ও বিশ্বাসের তালিকাজয় বাংলাহিমালয় পর্বতমালাকুমিল্লাময়মনসিংহমসজিদে নববীপর্তুগালবিশেষ্যপর্নোগ্রাফিফিতরাআন্দ্রে রাসেলযৌনাসনমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রফিলিস্তিনের ইতিহাসবাংলার শক্তিপীঠের তালিকামৌলানা আবুল কালাম আজাদ মেট্রো স্টেশনসিফিলিসসমাজতন্ত্রনিরাপদ যৌনতাজন্ডিসঅকাল বীর্যপাতকারাগারের রোজনামচাজেলেস্বামী বিবেকানন্দব্রহ্মপুত্র নদপদ্মা সেতুইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সযোনি পিচ্ছিলকারকবাংলাদেশের প্রশাসনিক অঞ্চলবাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা🡆 More